আইভীকে গ্রেপ্তারে বাধা: সাংবাদিকসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তারে বাধা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার অভিযোগে দায়ের মামলায় সাংবাদিকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তারা হলেন—মো. হানিফ (৫০), তার ছেলে জান্নাতুল ফেরদৌস জিসান (২১) ও চাচাতো ভাই শওকত মিথুন (৩৬)। তারা নগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদনগর এলাকার বাসিন্দা।
আজ মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জামাল উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত রাতে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন মৃধা বাদী হয়ে ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০-২০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
এই মামলায় এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও আসামি করা হয়েছে। পুলিশের গ্রেপ্তার ও আসামি তালিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
জিসানের চাচা হাবিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাত পৌনে ১টার দিকে সদর মডেল থানা পুলিশ বাসায় আসে। কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই তারা বাসায় ঢুকে তল্লাশি করতে শুরু করে। পরে জিসান ও তার বাবার নামে মামলা আছে বলে থানায় নিয়ে চলে যায়। কিন্তু কী মামলা সেটা আমাদের বলেনি।'
'সকালে আমরা জানতে পারি, আইভীকে গ্রেপ্তারে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা। কিন্তু ওই রাতে জিসান বা তার বাবা কেউ দেওভোগ এলাকায় যায়নি। আমাদের বাসা থেকে দেওভোগ তো কয়েক কিলোমিটার দূরে,' বলেন তিনি।
জিসানের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তিনি 'প্রেস নারায়ণগঞ্জ' নামে একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের সংবাদদাতা এবং প্রথম আলো পত্রিকার পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা জানান, জিসান জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন। আন্দোলনের সময় পায়ে আঘাতও পেয়েছিলেন।
জিসানের গ্রেপ্তারে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা এই ছাত্রনেতা।
গ্রেপ্তার শওকত মিথুন আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তিনি নারায়ণগঞ্জ টিভির প্রতিবেদক ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে করতে তার নির্মিত একাধিক ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মাহমুদা আক্তারকেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মিথুনের বড় ভাই শাহাদাত হোসেন মামুন বলেন, 'ঘটনার রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরছিল মিথুন। অনেক রাতে সে বাড়িতে ফেরে। ঘটনার সময় সে ছিলই না।'
তিনি আরও বলেন, 'গত রাতে পুলিশ মিথুনের সঙ্গে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকেও গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিল। পরে আমরা অনেক অনুরোধ করায় তাকে পুলিশ রেখে যায়।'
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করতে গেলে তার সমর্থকরা বাধা প্রদান করে এবং সড়কে ট্রাক দিয়ে বালি ফেলে ও বাঁশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে রাতভর পুলিশকেও অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সকালে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের দিকে নেওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু সড়কের কালিরবাজার মোড়ে আইভীর সমর্থক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাধা সৃষ্টি করে। পরে তারা আইভীকে বহনকারী পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ে। এতে পুলিশের তিনজন সদস্য আহত হন, উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
গত ৮ মে রাতে আইভীকে গ্রেপ্তার করতে নগরীর দেওভোগে তার পৈতৃক বাড়ি 'চুনকা কুটিরে' গেলে তার সমর্থক ও স্থানীয় এলাকাবাসী বাধা দেন। আইভীও জানান রাতের আঁধারে তিনি কোথাও যাবেন না। সকালে স্বেচ্ছায় তিনি পুলিশের গাড়িতে ওঠেন। তাকে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নেওয়ার সময় কালিরবাজার মোড়ে পুলিশের গাড়িবহরে হামলা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সাংবাদিক জানান, মহানগর যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা আইভীকে বহন করা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন। ওই সময় ককটেল বিস্ফোরণও ঘটে।
ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিওতে হামলাকারীদের মধ্যে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের একাধিক নেতাকর্মীকে দেখা যায়। পরে তারা বঙ্গবন্ধু সড়কে আওয়ামী লীগ ও আইভীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মিছিলও করেন।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) তাসমিন আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘটনার সময়ের সাক্ষ্য-প্রমাণ, ইন্টেলিজেন্স তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই-বাছাই করে আসামিদের শনাক্ত করে মামলায় এজাহারভুক্ত করা হয়েছে।'
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক শওকত আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ৫ আগস্টের আগে এই ধরনের ঘটনা দেখতাম। তখন অজ্ঞাত মামলায় মানুষকে গ্রেপ্তার করা হতো। এইখানে যদি বাবা আওয়ামী লীগ করে থাকে, তাহলেও তো তার দোষে তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে পারে না পুলিশ। যে অন্যায়কারী তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই ধরনের প্র্যাকটিস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা আইনে বলা আছে, একজন নিরপরাধও যেন হয়রানির শিকার না হন।'
Comments