রাতের ভোট, গুম, আন্দোলনে মারণাস্ত্র ব্যবহার: জবানবন্দিতে যা বললেন সাবেক আইজিপি মামুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা এক মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
পাঁচ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে ২০১৮ সালে ভোট জালিয়াতি, গুম, খুন ও জুলাই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে তিনি নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন সাবেক আইজিপি। গত ২৪ মার্চ তিনি ঢাকার একটি হাকিম আদালতে জবানবন্দি দেন।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের খাস কামরায় বিশ্রাম ও চিন্তা করতে আড়াই ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। এরপর জবানবন্দি রেকর্ড শুরু হয়।
পুলিশে গোপালগঞ্জের প্রভাব
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেননি উল্লেখ করে এই পুলিশ প্রধান বলেন, 'পুলিশ বাহিনীতে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমার সততা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় আইজিপি হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেন। পুলিশ বাহিনীর সুনাম ও কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব যাতে দেখা না দেয়, তার স্বার্থে আমাকে পরবর্তীতে দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হিসেবে আইজিপি করা হয়।'
তিনি বলেন, '২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিকক বিভিন্ন বলয় তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিষয় এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েন। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে আমার মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ সীমিত ছিল। রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকায় বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তারা স্বাভাবিক আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যাপক তৎপর ছিল।'
রাতের ভোটের পরামর্শ
আঠারোর নির্বাচন প্রসঙ্গে মামুন বলেন, 'সে সময় আমি ডিআইজি (ঢাকা রেঞ্জ) হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী রাতের বেলায় ব্যালট বাক্সে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো ব্যালট রাখার পরামর্শ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রদান করেন মর্মে শুনেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'মাঠ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ওই বিষয়ে রাতে ব্যালট বক্সে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা পাঠানো হয় এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় ও উদ্যোগে জেলা প্রশাসন, ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, এসপি ও থানার ওসিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।'
'পরবর্তীতে পুলিশের বিপিএম ও পিপিএম পদক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে বিবেচনা করা হতো। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পেশাদারিত্ব দেখানো হয়নি,' যোগ করেন তিনি।
সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, '২০১৮ সালের পর পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কিছু পুলিশ কর্মকর্তা প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতেন না।'
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীয় বাসায় প্রতি রাতে বৈঠক
'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় রাতের বেলায় নিয়মিত বৈঠক হতো, যা গভীর রাত পর্যন্ত চলতো। তার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল ডিএমপি কমিশনার হাবিব, ডিবির হারুন অর রশীদ, এসবির মনিরুল ইসলাম, ডিআইজি নুরুল ইসলাম, বিপ্লব কুমার, এডিশনাল এসপি কাফি, এসি মাজাহার, এসি ফরমান, ওসি অপূর্ব হাসানের। আরও বেশ কিছু অফিসার ও ওসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় নিয়মিত খেতেন। এরা কেউই আমার বা আইজিপির নির্দেশ সঠিকভাবে মানতেন না। মনে করতেন, তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। আইজিপি হিসেবে আমি চাইতাম পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক।'
কমান্ড মানতেন না গোপালগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তারা
পুলিশে অফিসার ও ওসি পর্যায়ে গোপালগঞ্জ জেলার প্রাধান্য ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, 'তারা সাধারণত কমান্ড মানতেন না। তারা নিজেদের ইচ্ছা মতো কাজ করতেন। এদের বিষয় সাধারণত দেখতেন আডিশনাল আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। ঢাকার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন।'
মামুন আরও বলেন, 'এসবি প্রধান মনিরুল ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। তারা আলাদাভাবে তাদের লোকজন ও সমমনা পুলিশ অফিসারদের মেইনটেইন করতেন। পুলিশ বাহিনীর ইমেজ রক্ষা ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমাকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগ ও পরবর্তীতে দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হয়।'
র্যাবের আয়নাঘর
মামুন বলেন, '২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম। মহাপরিচালক থাকার কারণে আমি জানি যে, টিএফআই সেল র্যাব সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হতো। এটির অবস্থান হলো উত্তরার রাব-১ এর কম্পাউন্ডের ভেতরে।'
'এছাড়াও, র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটগুলোর অধীনে আলাদা আলাদা সেল বা বন্দিশালা ছিল। যেগুলো সংশ্লিষ্ট র্যাব ইউনিটগুলোর প্রধানদের অধীনে পরিচালিত হতো। রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র্যাবের ভেতরে একটা কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এই কাজগুলো প্রধানত র্যাবের এডিজি (ওপিএস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন।'
গুম-ক্রসফায়ারের নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে
সাবেক এই র্যাব প্রধান আরও বলেন, 'র্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা বা গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এই ধরনের আদেশ পাইনি। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকর পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পারি। র্যাব যদিও পুলিশের আইজির অধীনে ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না এবং র্যাব প্রধানরা আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে কাজ করতেন।'
পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরও টিএফআই সেলে কতজন বন্দি আছেন সে বিষয়ে তাকে জানানো হতো না দাবি করে মামুন বলেন, 'এ বিষয়গুলো র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক দেখভাল করতো।'
'ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দি, আমি জানতাম'
তিনি বলেন, 'ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দি আছে, এ বিষয়টি আমি জানতাম। তবে তাকে আমার সময় তুলে আনা হয়নি। অনেক আগে তুলে আনা হয়। আমার পূর্ববর্তী ডিজি র্যাব বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব হস্তান্তরকালে ব্যারিস্টার আরমান যে টিএফআইতে আটক আছেন, তা আমাকে অবহিত করেন। পরবর্তীতে এজিডি (ওপিএস) ও ডিরেক্টর ইনটেল সরোয়ার বিন কাশেমও আরমান সাহেবের আটকের বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন।'
'তাকে তুলে আনা এবং বন্দি করে রাখার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল। তাকে টিএফআই সেলে আটক ও গুম করে রাখার বিষয়টি আমি পরে জেনেছি। এ বিষয়টি জানার পরে আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর সাথে কথা বলি। তারিক সিদ্দিকী আমাকে বলেন, ঠিক আছে রাখেন, বিষয়টি আপনাকে পরে বলবো। পরে তিনি আমাকে কিছুই জানাননি। এরপরও আমি বিষয়টি কয়েকবার তারিক সিদ্দিকীর কাছে উত্থাপন করি, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে আর কোনো নির্দেশনা দেননি। আমি র্যাব মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার হস্তান্তরের সময় পরবর্তী র্যাব মহাপরিচালক খুরশীদ হোসেনকে আরমানের বিষয়টি অবহিত করি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার র্যাবের দায়িত্ব পালনকালে যারা গোয়েন্দা শাখার পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, তারা হলেন সারওয়ার বিন কাশেম, খায়রুল ইসলাম ও মশিউর রহমান। আমি র্যাবে দায়িত্ব পালনকালে টিএফআই সেলে বিনা বিচারে বন্দিদের আটক রাখা এবং নির্যাতন করা বা কাউকে কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার কিছু কিছু বিষয় জানতাম, কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। কারণ এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য বাহিনীর এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধম্যে আসতো এবং তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করতো। এমনকি পুলিশ প্রধান হয়েও আমি র্যাবের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি বা করতে পারিনি।'
'কারণ এ বিষয়গুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করতো এবং কিছু কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর কাছ থেকে নির্দেশনা আসতো। অনেক ক্ষেত্রে আমার কথাকে গুরুত্ব দিতো না,' মামুন উল্লেখ করেন জবানবন্দিতে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে র্যাব গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য ও পরামর্শের ভিত্তিতে আভিযানিক কাজ পরিচালনা করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে আইজিপিকে প্রায়শই জিজ্ঞাসা করা হতো না। র্যাবের আলেপ উদ্দিন ও মহিউদ্দিন ফারুকীকে আমি চিনতাম। আলেপ প্রথম নারায়ণগঞ্জে র্যাবে ছিল, পরবর্তীতে এডিজি (ওপিএস) এর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে র্যাব গোয়েন্দা শাখায় পদায়ন করা হয়। গোয়েন্দা শাখায় অনেক অফিসার ছিল। গুমসহ বিভিন্ন অপেশাদার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে আলেপের বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে র্যাবের অফিসাররা পছন্দ করতো। কারণ সে এই কাজে পুলিশ অফিসারদের মধ্য থেকে নিয়োজিত অফিসার হিসেবে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল।'
'নির্যাতনের সাথে জড়িত র্যাবের বাকি অফিসারদের অধিকাংশই ছিল মিলিটারি অফিসার। কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো জেনারেল তারিক সিদ্দিকী সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। এ ব্যপারে পুলিশের আইজি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সব কিছু অবহিত করা হতো না।'
জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমাতে কোর কমিটির মিটিং
জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাত ৮-৯টার দিকে কোর কমিটির মিটিং হতো জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমি কোর কমিটির সদস্য হিসেবে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতাম। সেখানে স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান ও রেজা মোস্তফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাব ডিজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, বিজিপির ডিজি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার জিডি মেজর জেনারেল এ.কে.এম আমিনুল হক, এনটিএমসির ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধান উপস্থিত থাকতেন। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের বিভিন্ন নির্দশনা ও পরামর্শ আমাদের সাথে শেয়ার করতেন।'
'কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিএফআই ও ডিবি প্রধান হারুনকে আটক করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয় এবং সরকারের সাথে আপস করার জন্য বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন ও চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও নিয়ে আসা হয়। সমন্বয়কদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়।'
মামুন বলেন, 'কোর কমিটির মিটিংয়ে তাদেরকে আটকের বিষয়ে আমি বিরোধিতা করি, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে তাদের আটক করা হয়। ডিবি প্রধানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের গভীর সম্পর্ক ছিল। আসাদুজ্জামান খান কামাল হারুনকে জ্বিন নামে ডাকতেন। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে খুব কার্যকর মনে করতেন।'
'আন্দোলন দমাতে এক পর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনে নজরদারি, গুলি করা ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গোপন পরিকল্পনা করা হয়। আমি পরে জানতে পারি, ডিজি র্যাবের পরিকল্পনায় ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। তবে পুলিশ প্রধান হিসেবে আমি ওই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলাম না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়,' যোগ করেন তিনি।
সাবেক আইজিপি বলেন, 'আন্দোলন দমাতে পরবর্তীতে মারণাস্ত্র ব্যবহার ও আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে ভাগ করে ব্লক রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে আমাকে জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য মারণাস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।'
'এ সময় আমার সামনে এডিশনাল ডিআইজি (সদর দপ্তর) প্রলয় জোয়ার্দ্দার উপস্থিত ছিলেন। তার মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই নির্দেশনা জানতে পারেন।'
মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ডিএমপি কমিশনারের সরাসরি যোগাযোগ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ডিএমপি প্রধান ও ডিবি প্রধান মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন, যে কোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। গত বছরের ১৮ জুলাই ডিএমপি কমিশনার প্রকাশ্যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দেন।'
'প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম মেম্বার জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আলম, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরফাত, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ এবং উসকানি দিতেন। দেশব্যাপী এত অধিক সংখ্যার মানুষ মারা যাওয়ার পরেও তারা তাদের উসকানি বন্ধ করেননি কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে থামতে বলেননি।'
গত বছরের ১৭ জুলাই ছাত্রলীগ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নৃশংস হামলা করে, সেখানে পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মূলত ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ কাজ করে। ছাত্রলীগকে ওবায়দুল কাদের, নানকসহ কিছু নেতা লেলিয়ে দেন।'
'সরকারকে বিপথে পরিচালিত করে ও আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার সবাই আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদের আগ্রাসী বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যের ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের ও নানক ছাত্রলীগ-যুবলীগকে নির্দেশনা দিতেন।'
শেষ রক্ষার চেষ্টা
গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মামুন। তিনি জানান, সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়।
'আন্দোলন দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায় যে, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি, সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিং চলাকালে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে ও বিভিন্নস্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।'
'রাতে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী, তার বোন শেখ রেহানা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাব প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এসবি প্রধান মনিরুল বাইরে বসে ছিলেন। জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআই প্রধান বাইরে ছিলেন। খোলামেলা কথা হয়। কীভাবে ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায় তা নিয়ে কথা হয়। ফোর্স মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই বৈঠক প্রায় ৩০-৪৫ মিনিট হয়। বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, র্যাব প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএমপি কমিশনার ও আমি ছিলাম।'
'সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশ মুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। পুলিশ সেনাবাহিনীর সাথে সমন্বয় করে কাজ করবে সিদ্ধান্ত হয়।'
'পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের (পুলিশ) শক্ত অবস্থান ছিল। ঢাকার প্রবেশ মুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ সদর দপ্তরে অবস্থান করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তারা নির্দেশনা দেন। সকাল ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি যে, সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।'
তিনি বলেন, 'দুপুর ১টার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকাতে। আমি দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি যে, সরকার পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারত যাবেন কি না তা জানতে পারিনি। সোনাবাহিনী তা জানায়নি।'
'বিকেলে জানতে পারি পুলিশ অফিসারদের নেওয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে হেলিকপ্টার আসবে। আমি ওই হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই এবং সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে আশ্রয় গ্রহণ করি।'
ক্ষমাপ্রার্থী আবদুল্লাহ আল-মামুন
'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনার এবং অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বাচারে নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করার সাবেক পুলিশ প্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।'
জবানবন্দিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'আমি সারা জীবন সততা, নিষ্ঠা ও আইন অনুসরণের মাধ্যমে আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করি। সরকারের পতন, জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ও বিবেকের তাড়নায় আমি স্বেচ্ছায় এই জবানবন্দি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।'
Comments