অস্ত্রধারীদের দেখামাত্র আত্মরক্ষায় গুলির নির্দেশ সিএমপি কমিশনারের

পুলিশের কোনো টহল দলের সামনে কিংবা অভিযানের সময় কেউ অস্ত্র বের করলে আত্মরক্ষায় দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ।
চট্টগ্রাম নগরীর ঈশান মিস্ত্রির ঘাট দুর্বৃত্তদের হামলায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সাঈদ ওরফে রানা আহত হওয়ার পর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ওয়্যারলেসে সিএমপির সব সদস্যদের উদ্দেশে তিনি এই মৌখিক নির্দেশ দেন।
চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার সল্টগোলা এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল বের করেছেন—এমন তথ্য পেয়ে সোমবার দিবাগত রাতে রানা ও আরও দুইজন পুলিশ সদস্য অভিযানে গিয়েছিলেন। একটি বাসায় তল্লাশি চালাতে গেলে দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রানার মাথা গুরুতর জখম হয়।
পরবর্তীতে যৌথবাহিনীর অভিযানে ওই এলাকা থেকে কিরিচ, ছুরি ও ধারালো অস্ত্রসহ ১৮ জন গ্রেপ্তার হন।
হাসিব আজিজ তার নির্দেশনায় বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে অস্ত্রের যে প্রাধিকার ছিল, ওই প্রাধিকার অনুযায়ী সিএমপির সদস্যরা এখন থেকে অস্ত্র বহন করবে।
বিভিন্ন থানার পরিদর্শক ও এসআই সমমর্যাদার প্রায় পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ডেইলি স্টার এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে।
আহত পুলিশ সদস্য শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর জোনের উপকমিশনার (ডিসি) মো. আমিরুল ইসলাম। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আহত পুলিশ সদস্যের সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করানো হয়েছে। তিনি বেঁচে আছেন এটাই অনেক। চট্টগ্রাম মেডেকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তার চিকিৎসায় সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে।'
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে অনেকে নিহত হন। ফলে জনআক্রোশ বাড়তে থাকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দেশব্যাপী পুলিশের ওপর হামলা হয়। দেশব্যাপী থানা, ফাঁড়ি, পুলিশের যানবাহন ভাঙচুর ও অস্ত্র-গুলি লুট হয়। সারা দেশে প্রাণ হারান ৪৪ পুলিশ সদস্য।
তাদের ভাষ্য, এরপর পুলিশের সক্রিয় হতে বেশ সময় লাগে। তবে পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র বহন করতে চাননি। পুলিশিং স্বাভাবিক হলেও এখনো পুলিশ সদস্যরা চিন্তা-ভাবনা করে অস্ত্র বহন করেন।
বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর নিয়মিত হামলার ঘটনায় নতুন করে অস্ত্র বহনের প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে, বলেন তারা।
সিএমপি কমিশনার ওয়ারল্যাস বার্তায় হাসিব আজিজ নির্দেশনায় বলেছেন, '২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে যে অস্ত্রের প্রাধিকার ছিল, ওই প্রাধিকার অনুযায়ী থানার মোবাইল পার্টি, পেট্রোল পার্টি, ডিবির টিমসমূহ ও সকল ফোর্স অস্ত্র ক্যারি করবে।'
'আগ্নেয় অস্ত্র ছাড়া এবং লাইভ এমুনিশন ছাড়া কোনো পেট্রোল পার্টি, মোবাইল পার্টি, ডিবির পার্টি, চেকপোস্ট পার্টি বের হবে না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগের প্রাধিকার অনুযায়ী লাইভ এমুনিশন ছাড়া কেউ বের হবে না। প্রাধিকার অনুযায়ী অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং স্যুট পরে তারপর ডিউটিতে যাবে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'শুধুমাত্র রবার বুলেট দিয়ে কাজ হচ্ছে না। বন্দরে (বন্দর থানা) একজন এসআই গুরুতর আহত হয়েছেন। আরেকদিন আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটবে। বন্দর থানার অফিসার যে অবস্থায় পড়েছেন, ওই পরিস্থিতিতে পড়লে যেন লাশ ছাড়া মোবাইল পার্টি, পেট্রোল পার্টি ফেরত না আসে। পুলিশের কোনো টহল পার্টির সামনে অস্ত্র বের করলে, আই রিপিট, সেটা ধারালো অস্ত্র হতে পারে কিংবা আগ্নেয় অস্ত্র হতে পারে—অস্ত্র বের করা মাত্র গুলি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নাই, সবাইকে বলছি। আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার, দণ্ডবিধি ৯৬ থেকে ১০৬ পর্যন্ত, আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার সকল পুলিশ অফিসারের আছে। অস্ত্র কিংবা কোপ দেওয়ার আগে অস্ত্র বের করা মাত্র গুলি হবে। সরকারি গুলির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।'
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, এসআই রানা যখন হামলার শিকার হন, তখন তার সঙ্গে থাকা দুই কনস্টেবল শটগান বহন করছিলেন। তবে তারা গুলি ছোড়েননি।
এই নির্দেশনার পর পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কমপক্ষে পাঁচজন পুলিশ সদস্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, পুলিশের অনেক সদস্য এখনো ট্রমায় আছেন। অভিযানে গেলে মব কিংবা দলগতভাবে জনতার হামলার একটা বিষয় থাকে। অনেক দিক বিবেচনায়, বিশেষ করে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পুলিশকে কাজ করতে হয়, হচ্ছে।
'নির্দেশনা থাকলেও আমরা কেউ চাই না অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কারও মৃত্যু হোক। আবার গুলি চালালেও পরবর্তীতে ওই পুলিশ সদস্যকে নানা আইনি তলবের মুখোমুখি হতে হয়,' বলেন তারা।
জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পেনাল কোডের ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় বলা আছে, আক্রান্ত হলে পুলিশ কী করতে পারবে আত্মরক্ষায়। এখানে সেই ধরনের পরিস্থিতি ছিল। আমার অফিসারের মাথা ধর থেকে আলাদা করে ফেলতো তারা। আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন।'
'পেনাল কোড অনুযায়ী আমার ফোর্স আত্মরক্ষায় যা করা লাগে করবে। কেউ তো কোপ খাওয়ার জন্য বসে থাকবে না,' যোগ করেন তিনি।
হাসিব আরও বলেন, 'আহত অফিসারের সঙ্গে যে দুজন কনস্টেবল ছিল, তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। তারা নিজেরাও আক্রান্ত হতে পারতো। তারা কেন গুলি করল না তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার নির্দেশ দিয়েছি।'
Comments