মোহাম্মদপুর, আদাবরে কিশোর গ্যাংয়ের দাপট

এআই জেনারেটেড ছবি

মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে আদাবরের ১০ নম্বর রোডের বালুর মাঠে দাঁড়িয়ে টিনের ঘরগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি।

তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে ভাড়া নেওয়া জমিতে চারটা ঘর তুলেছিলেন। একটি তার পরিবারের জন্য বাকি তিনটি সাবলেট দিয়ে মাসে ৯ হাজার টাকা আয় করতেন।

এটিই ছিল দিনমজুর জলিলের (ছদ্মনাম) আয়ের প্রধান উৎস।

কিন্তু গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটলে স্থানীয় কিশোর গ্যাং যখন তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি শুরু করে, তখন থেকেই তার জীবনের দুর্দিন শুরু হয়।

তিনি বলেন, 'প্রায় এক মাস আগে মনির ও গুজা মনিরের লোকজন আমার কাছে প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিতে চাইলে নির্দয়ভাবে পেটায়। বলে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা না দিলে আবারও মারবে।'

পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ঢাকা উদ্যান হাউজিংয়ে ঘর ভাড়া করে চলে যান। পুলিশের উপর হামলার পর গত মঙ্গলবার আদাবরে ব্যাপক যৌথ অভিযান শুরু হলে তিনি ভাড়াটেদের খোঁজ নিতে সেখানে আসেন।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় দুর্বৃত্তদের আতঙ্কে তিনি তার ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। 

এমন গল্প এখন ওই এলাকায় সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, নিয়মিত চাঁদা দিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন, নয়তো হামলার শিকার হতে হয় এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন তারা।  রাতে মানুষ বাইরে বের হতে সাহস পায় না। গ্যাং সদস্যরা মানুষকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চায়, মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়, এমনকি প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনাও করে।

কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করে না, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন একজন বাসিন্দা।

স্থানীয়রা জানান, চাঁদাবাজির বৈধতা দেখাতে গিয়ে এইসব গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রায়ই বলে, জামিন খরচ মেটাতে টাকা লাগে।

জলিলকেও এমনটাই বলা হয়েছিল। সম্প্রতি কয়েকজন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, তাকেও কিছু দিতে হবে।

জলিলের মতো অনেকেই বালুর মাঠ ভাড়া নিয়ে সেখানে টিনের ঘর বানিয়ে ভাড়া দেন।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় একাধিক গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন আনোয়ার। যিনি 'কবজি কাটা আনোয়ার' নামে পরিচিত। 

যদিও গ্যাংয়ের এখন এসব সদস্যের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, তবুও তাদের 'কিশোর গ্যাং'ই বলা হয়, কারণ তারা বেশিরভাগই অল্প বয়সে এসব কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল।

গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, গত কয়েক বছরে তারা ছোটখাটো চাঁদাবাজ থেকে এখন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অংশে পরিণত হয়েছে।

তারা জানায়, প্রায়ই নেতৃত্ব বদলায়, তবে ধারা একই থাকে—একজন গ্রেপ্তার হলেই নতুন নেতা উঠে আসে, যে আগের জনের চেয়েও বেশি সহিংস হয়ে ওঠে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব কিশোর গ্যাংগুলো দরকারে রাজনৈতিক আশ্রয় বদলে ফেলে এবং যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের কাছেই আশ্রয় খোঁজে।

র‍্যাব-২-এর কমান্ডিং অফিসার খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা থেকে ৮৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অন্তত ২০টি গ্রুপ শনাক্ত করেছি। এর মধ্যে কবজি কাটা আনোয়ার ও টুনডা বাবুর গ্রুপ সবচেয়ে শক্তিশালী। কিছু গ্যাংয়ে ২০-৩০ জন থাকে, আবার কোনোটাতে ৬০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। এদের অনেকে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে, কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে আরও আগ্রাসীভাবে চাঁদাবাজি শুরু করেছে।'

খালিদুল আরও বলেন, 'আমরা একজনকে দুই থেকে তিনবার গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাদের নজরদারিতে রাখতে ও আটক করতে।'

২০টি গ্যাংয়ের মধ্যে নয়টি মূলত মোহাম্মদপুর ও আদাবরে সক্রিয়। আনোয়ারের 'কবজি কাটা গ্রুপ' ছাড়াও এদের মধ্যে রয়েছে 'কিলার আরমান গ্রুপ', 'টুনডা বাবু গ্রুপ', 'বোমা গ্রুপ", 'গিট্টা গ্রুপ', 'কসাই গ্রুপ', "পাতালি গ্রুপ', 'বুনিয়া সোহেল গ্রুপ' এবং 'আরশাদ ওরফে আয়েশা গ্রুপ'।

ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. শামসুদ্দোহা সুমন মনে করেন, এফআইআরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রায়ই জামিন পেয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, এছাড়াও যারা কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি পুলিশও শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করতে পারে না।

তবে আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম জাকারিয়া এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, আমরা যথাযথভাবে প্রমাণসহ অভিযুক্তদের হাজির করি। কিন্তু কীভাবে তারা জামিন পেয়ে যায় তা আমরা জানি না।

কিশোর গ্যাংয়ের সবশেষ সহিংসতার ঘটনায় গত সোমবার রাতে হামলার শিকার হয়েছে পুলিশের একটি দল। ওই রাতে দায়িত্ব পালনরত এক কনস্টেবলকে কুপিয়ে আহত করা হয়। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেসে চিকিৎসাধীন।

হামলাকারীরা পুলিশের একটি গাড়িও ভাঙচুর করে।

স্থানীয়রা জানান, আনোয়ারের অনুপস্থিতিতে তার 'কবজি কাটা গ্রুপ' এখন চালাচ্ছে রনি-জনি নামে দুই ভাই। পুলিশের ওপর হামলার মূল পরিকল্পনাকারীও তারা। এই দুই ভাইয়ের সাথে আছে তুষার নামে আরেক সহযোগী। র‍্যাব গত ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারকে (যিনি শ্যুটার আনোয়ার নামেও পরিচিত) গ্রেপ্তার করার পর থেকে তারাই এই গ্যাং চালিয়ে আসছে।

পুলিশ জানায়, গত সোমবার ৯৯৯ এ কলে তারা খবর পায় আদাবরের সুনিবিড় হাউজিংয়ের একটি গ্যারেজে এক যুবক ও এক নারীকে আটকে রাখা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে রনি, জনি ও তাদের সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়।

এই ঘটনার পর পুলিশ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০২ জনকে আটক করে এবং অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করে।

গতরাতে ডিএমপি জানায়, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ভোরে কেরানীগঞ্জ ও সাভার থেকে প্রধান সন্দেহভাজন জনি (২৪) এবং রনিসহ (২৭) গ্যাংয়ের আরও সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুটি ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, আসামিরা পুলিশের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক সেবন, ইভটিজিং, অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি এবং জোর করে জমি-বাড়ি দখলসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

সূত্র জানায়, পুলিশের ওপর হামলার রাতে গ্যাং সদস্যরা মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়েও হামলা চালায় এবং দুটি রিকশার গ্যারেজে ভাঙচুর চালায়।

রিকশা গ্যারেজের মালিক রাশেদ জানান, হামলাকারীরা দুইটা রিকশা গ্যারেজ থেকে লুট করে, ম্যানেজারকে কুপিয়ে জখম করে এবং চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় ৩ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী রফিক বলেন, ঘটনাটি তাদের জানা ছিল না। গ্যারেজ মালিক রাশেদ বলেন, ঢাকার বাইরে থাকার কারণে তিনি পুলিশকে জানাননি।

চাঁদাবাজি আর মুক্তিপণের বাইরে এখন গ্যাংগুলোর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে বড় জমি ও সম্পত্তিতেও। 

মোহাম্মদপুরের এক ব্যবসায়ী জানান, তিন বছর আগে তিনি ৩ কোটি টাকায় একটি প্লট কিনেছিলেন। তখনই তাকে একটি গ্যাং-কে ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছিল। একই লোকেরা এখন আরেকটি গ্রুপে যোগ দিয়ে আবারও ১০ লাখ টাকা চাইছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এটিই আমাদের সবচেয়ে আতঙ্কিত করে। যাই ঘটুক না কেন, হুমকি থেকেই যায। একবার টাকা দিয়েছি, এখন আবার দাবি করছে।

মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকার আরও কয়েকজন সম্পত্তির মালিক ও ব্যবসায়ীও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেন, গ্যাং আর রাজনৈতিক জোটবদলের ফাঁদে পড়ে বারবার তারা তাদের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডেপুটি কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, 'আমাদের অভিযানে প্রায়ই গ্যাং নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে আমরা প্রায়ই নতুন নাম শুনি।

'এই কিশোর গ্যাং সদস্যরা মূলত ভাসমান এবং তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, যার কারণে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে নিশ্চিত থাকুন, আমরা তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনব।'

Comments

The Daily Star  | English
Dhaka-Chattogram fuel pipeline trial run

Chattogram-Dhaka pipeline: Inaugurated 20 days ago but no fuel delivered

Diesel supply through the Chattogram-Dhaka Fuel Pipeline is yet to start, almost 20 days after its launch, as the authorities proceeded with inauguration despite having issues during trial runs.

12h ago