বিপিসি চেয়ারম্যানসহ জ্বালানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর থেমে নেই

জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ১১ কর্মকর্তা বিদেশ সফরের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। এর মধ্যে ১ জন ইতোমধ্যে সফরে গেছেন। অন্যদের ভ্রমণ ভিসা জটিলতায় আটকে আছে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ১১ কর্মকর্তা বিদেশ সফরের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। এর মধ্যে ১ জন ইতোমধ্যে সফরে গেছেন। অন্যদের ভ্রমণ ভিসা জটিলতায় আটকে আছে।

গত ১৬ আগস্ট বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন। তার সঙ্গে আরও ৩ জনের সফরে যাওয়ার কথা ছিল। তাদের মধ্যে একজন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবং বাকি ২ জন পদ্মা অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প কর্মকর্তা। ২৬ জুলাই তাদের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র সফরের দলে নাম থাকা পদ্মা অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) নোমান আহমেদ তফাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৩টি রিফুয়েলার স্থাপনের কাজ চলছে। রিফুয়েলারগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হচ্ছে। বিপিসি চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে রিফুয়েলার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি ইন্সপেকশনে গেছেন। আমরা পরে যুক্তরাষ্ট্রে যাব।'

সরকারি আদেশে বলা হয়েছে, বিপিসির চেয়ারম্যানসহ ৪ কর্মকর্তা একটি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি 'প্রি-শিপম্যান্ট ইন্সপেকশন'র জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দিন অবস্থান করবেন। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

প্রকল্পের চুক্তিপত্র অনুযায়ী, এই সফরের খরচ যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি বহন করবে।

বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জিও ইস্যু হওয়ার পরও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভিসা জটিলতায় যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারেননি। কিন্তু বিপিসির চেয়ারম্যানের আগে থেকেই ভিসা থাকায় তিনি একাই চলে গেছেন। যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্ঠদের যাওয়াটাই বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল। ভিসা প্রক্রিয়ার জন্য চেয়ারম্যান অপেক্ষা করে এক সঙ্গে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।'

তিনি আরও বলেন, 'এ বি এম আজাদ বিপিসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়ালেখা করেছেন। তিনি কোনো টেকনিক্যাল পারসন নন। তারপরও তিনি যুক্তরাষ্ট্র গেছেন।'

বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে গত ১২ মে পরিপত্র দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও বারবার বলা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ রাখতে।

এর মধ্যেই বিপিসির ২ পরিচালকের নেতৃত্বে আরও দুটি দলে মোট ৮ জন কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য সরকারি আদেশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম তেলের পাইপ লাইন প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া এবং প্রকল্প পরিচালক পদ্মা অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মো. আমিনুল হকের যুক্তরাজ্যে একটি কারখানা পরিদর্শন করার কথা আছে। ওই কারখানা থেকে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। গত ১৯ জুলাই তাদের সফরের সরকারি আদেশ জারি হলেও তারা এখনো যেতে পারেননি।

যুক্তরাজ্য সফর প্রসঙ্গে জানতে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তেলের পাইপ লাইন প্রকল্প কাজের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য যাওয়ার জন্য জিও জারি হয়েছে। তবে আমাদের এখনো ভিসা হয়নি।'

এদিকে, ইস্টার্ন রিফাইনারির 'অটো ট্যাংক গ্যাজিং'য়ের ঠিকাদারি পেয়েছে যুক্তরাজ্যে মাদার অয়েল অটো ট্যাংক গ্যাজিং লিমিটেড। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যুক্তরাজ্যে তাদের কারখানা পরিদর্শন করানোর কথা।

এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন বিপিসি, জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ৬ কর্মকর্তা। তাদের সফরের জন্য ইতোমধ্যে জিও জারি হয়েছে।

এই দলের নেতৃত্বে আছেন বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ইলিয়াস হোসেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান, উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাহ উদ্দিন খালেদ এবং বিপিসির উপ ব্যবস্থাপক মো. আহমেদুল্লাহ।

জানা গেছে, বিপিসির উপ ব্যবস্থাপক মো. আহমেদুল্লাহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা নন। তারপরও বিপিসির চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী হওয়ায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ইস্টার্ন রিফাইনানরির কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিদেশ সফরে বিপিসি ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত না করলে প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে গড়িমসি করেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বিপিসির সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বিপিসিতে যোগদানের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া আগে এলজিআরডিতে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিপিসির চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী মো. আহমেদুল্লাহসহ এই ৩ জনের কারোকারিগরি ব্যাপারে বিশেষায়িত জ্ঞান নেই।

বিদেশ সফর প্রসঙ্গে জানতে ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে এই সফর। করোনা মহামারির কারণে উন্নয়ন কাজ আটকে ছিল। এখন আবার কাজে গতি বেড়েছে। আমদানি করা যেসব যন্ত্রপাতি প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হবে সেগুলো মানসম্মত কি না তা দেখতে বিদেশে কারখানা পরিদর্শনে যাচ্ছি।'

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'অনলাইনে যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আমাদের বিশেষজ্ঞদের তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে এসব বিষয় সুরাহা করা সম্ভব ছিল। সেই চেষ্টা করা হয়েছে কি না সেটা দেখা দরকার। কেননা, কৃচ্ছ্র সাধনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আগের কোনো নির্দেশনা থাকলেও বর্তমান নির্দেশনাটিই কার্যকর বলে বিবেচিত হবে। কাজেই সেই চেষ্টা যদি না করা হয়ে থাকে তাহলে পুরো সিদ্ধান্তটাই দুরভিসন্ধিমূলক। সরকারি কাজে বিদেশ সফরকে যে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, এটি তারই একটি প্রমাণ।'

বিপিসির চেয়ারম্যানের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ভিসা জটিলতায় প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মকর্তাদের যেহেতু যাওয়া হয়নি, সেখানে চেয়ারম্যানের একার ভ্রমণটি আরও অযৌক্তিক বলে মনে করি। এই সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে। তার এই সিদ্ধান্ত নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।'

সংশ্লিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠানের খরচে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের বিষয়ে তিনি বলেন, 'প্রথমত এটা স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তা ছাড়াও, ওই প্রতিষ্ঠান যে খরচটা করবে, চূড়ান্তভাবে সেই খরচের চাপটা আমাদের ওপরই পরবে। এই প্রতিষ্ঠানটি কোনো দাতব্য সংস্থা না। কাজেই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এমন ভ্রমণের ব্যয় কোনো না কোনোভাবে আমাদের কাছ থেকেই আদায় করে নেবে।'

এই সফরে বিপিসির চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী মো. আহমেদুল্লাহ থাকার বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'প্রভাবশালী কর্মকর্তারা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, মন্ত্রীর পিএস বা এপিএসরা এসব সুবিধা নেন। টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে বিদেশ সফরে বিপিসি চেয়ারম্যানের সহকারীর কোনো ভূমিকা নেই। তার কর্ম পরিধির মধ্যে এটা পড়ে না।'

Comments