এএনআইকে প্রধানমন্ত্রী: ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন স্মিতা প্রকাশ। ছবি: এএনআই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফর করবেন। তার ভ্রমণসূচি অনুযায়ী, ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নয়াদিল্লি পৌঁছাবেন তিনি। ৬ সেপ্টেম্বর তার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। একই দিন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি।

এই সফরের প্রাক্কালে ভারতীয় গণমাধ্যম এএনআই শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায়। ঢাকায় এসে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশ।

ইংরেজি সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করে দ্য ডেইলি স্টার বাংলার পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

এএনআই: সেপ্টেম্বরে আপনি ভারত সফরে আসছেন। এটা নিঃসন্দেহে ভারত ও বাংলাদেশকে আরও কাছে নিয়ে আসবে। এই সফরে আপনার অগ্রাধিকার কী থাকবে, সে সম্পর্কে কী কিছু বলবেন?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। আমরা সব সময় মনে রাখি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাদের অবদানের কথা। এমনকি ১৯৭৫ সালে যখন আমার পরিবারের সব সদস্যকে হারালাম, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদেরকে ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমরা সবসময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বে গুরুত্বারোপ করি। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, এটা শুধু নেতৃত্ব পর্যায়ের জন্য না, এটা জনগণের জন্য। ভারতের মানুষ, প্রধানমন্ত্রী, নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির প্রতি শুভ কামনার পাশাপাশি আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার ওপর। এই সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রপতির প্রতি। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় তারা দুজনেই বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সেই সময় করোনা মহামারি চলছিল। তারপরও তারা এসেছিলেন এবং আমাদের জনগণকে সম্মানিত করেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব সবসময়ের। বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। কাজেই এটি আমাদের অগ্রাধিকারে থাকবে।

এএনআই: আপনি বাণিজ্যের কথা বলছিলেন। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। অনেক ভারতীয় মনে করেন, ভারত তো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হতে পারে। ছোট একটি দেশ হিসেবে ভারত ও চীনের সঙ্গে আপনারা কাজ করে যাচ্ছেন। এই ২ দেশের সঙ্গে সম্পর্কে কীভাবে ভারসাম্য রাখেন? যদিও আমি নিশ্চিত যে এই প্রশ্নের মুখোমুখি আপনি আরও অনেকবার হয়েছেন।

শেখ হাসিনা: আমাদের পররাষ্ট্রনীতি খুবই পরিষ্কার—সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে এটা বলেছিলেন জাতিসংঘে। আমরা তার সেই মতাদর্শ অনুসরণ করে চলি। আমি মনে করি, আমাদের উচিৎ জনগণকে কেন্দ্র করে কাজ করা। কীভাবে তাদেরকে আরও ভালো জীবন দেওয়া যায়, কীভাবে তাদের জীবনমান আরও ভালো করা যায়। আমি সব সময়ই বলি, আমাদের একমাত্র শত্রু দরিদ্রতা। কাজেই চলুন একসঙ্গে কাজ করি, দরিদ্রতা কমাতে। দক্ষিণ এশিয়া, চীন— সব জায়গাতেই জনগণের জন্য একটি উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে আমাদের কাজ করতে হবে, তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে।

আমি মনে করি, ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকেও থাকে, সেখানে আমি নাক গলাতে চাই না। আমি চাই আমার দেশের উন্নয়ন। ভারত আমাদের ঠিক পাশের রাষ্ট্র, সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। আমাদের মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে সমস্যা রয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে আমরা এর মধ্যে অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। আপনি জানেন, পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত সমস্যা সমাধান হয়েছে। ২ দশক ধরে ভারতে থাকা আমাদের রিফুজিদের আমি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি এবং পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময় তাদেরকে সেটেল করেছি।

আমি মনে করি ছিটমহল বিনিময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। অনেক দেশ এর জন্য যুদ্ধ করে, কিন্তু আমরা তা করিনি। বন্ধুত্বের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যার সমাধান করেছি এবং ছিটমহল বিনিময় করেছি। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সব সংসদ সদস্যদের এবং ভারত সরকারকে—তারা আইন পাশ করায় এই সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি।

অনেকে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশ থেকে আমাকে এই প্রশ্ন করেন। ভারত ও চীন উভয় দেশের জন্যই আমার মনে হয়, আমাদের যুদ্ধ করা উচিত না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোনো সমস্যা থাকলে তা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা উচিত। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন আপনি পাশাপাশি থাকবেন, তখন কিছু সমস্যা আসবেই, থাকবেই। সেগুলো আপনি সমাধান করতেই পারেন। আমাদের কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু আমরা আলোচনা চালিয়ে যাব এবং নিজেরা সমাধান করে নিতে পারব।

আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য যারাই অফার করবে, আমাদের জন্য তার মধ্যে যেগুলো সুইটেবল হবে, সেটা আমরা নিব।

এএনআই: প্রধানমন্ত্রী মোদির 'নেবারহুড ফার্স্ট' ও 'লুক ইজ অ্যাক্ট ইজ' নীতি পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে রয়েছে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের এসেছিলেন। আপনি তাকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছেন। আপনি কী দেখতে পাচ্ছেন যে এই অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের যোগাযোগ বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে হতে পারে?

শেখ হাসিনা: যখন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ক্ষমতায় ছিলেন তখন আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাস যোগাযোগ শুরু করি। ধীরে ধীরে এই যোগাযোগ বেড়েছে। আমাদের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর আছে। ২০১৮ সালে আমরা চুক্তি সই করেছি এবং এর বাস্তবায়নে কাজ চলছে। এতে ভারত যেমন তাদের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে তেমনি বাংলাদেশও উপকৃত হবে।

শুধু তাই নয়, আমি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহারের কথাও বলেছি। সেটিও তারা ব্যবহার করতে পারেন। চট্টগ্রামের পাশাপাশি সিলেট বিমানবন্দরও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আমি সৈয়দপুর বিমানবন্দরেরও উন্নয়ন করছি। সেটি একটি আঞ্চলিক বিমানবন্দর হবে বলে আমি ঘোষণা দিয়েছি। শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভূটানসহ সব দেশ এটা ব্যবহার করতে পারে।

এএনআই: আপনি অক্লান্তভাবে মানুষের উন্নয়নে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে কাজ করছেন। ভারতে অনেকে দেখছেন সিপা (কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমি পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) কার্যকর হলে আপনার দেশের ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি হবে, এমনকি গ্রামীণ জনমানুষেরও। আপনার এই সফরে সিপা বিষয়ে আলোচনা হবে?

শেখ হাসিনা: এটি বাস্তবায়ন কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করব। সম্পর্ক উন্নয়নে যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় আমরা এগিয়ে যাব এবং এর থেকে জনগণও অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে।

 

এএনআই: ব্যক্তি জীবনে আপনি অনেক ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। আপনার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা অনেকেই ৭০-৮০ দশকের সেই সময়ের কথা মনে করতে পারি। তরুণ ভারতীয়দের অনেকেই সেই বিষয়ে জানে না। সেই সময়ের কথা যদি আপনার কাছে শুনতে পাই।

শেখ হাসিনা: ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হলো, আমার মাকে কাস্টডিতে রাখা হলো। আমি পরিবারের বড় সন্তান। ভারত সরকার, ভারতের জনগণ আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে সব হঠাৎ করেই হয়ে গেল। ঘটনার মাত্র ১৫ দিন আগে আমি ও আমার বোন (শেখ রেহানা) দেশ ছেড়ে যাই। আমরা জার্মানিতে গিয়েছিলাম। আমার স্বামী ছিলেন আণবিক বিজ্ঞানী। তিনি সেই সময়ে গবেষণার কাজে জার্মানিতে ছিলেন। আমরা জার্মানি গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য।

এএনআই: আপনার বাবা ও মায়ের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ কবে হয়েছিল?

শেখ হাসিনা: ৩০ জুলাই (১৯৭৫)। আমার স্বামী যেহেতু বিদেশে ছিলেন, আমিও সেখানেই যাচ্ছিলাম। সেদিন সবাই বাসায় ছিলেন। আমার বাবা, মা, ৩ ভাই, ভাবীরা— সবাই সেখানে ছিলেন। সবাই আমাকে বিদায় দিতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। সেটিই ছিল তাদের সঙ্গে শেষ দেখা।

এরপর ১৫ আগস্ট সকালে আমরা খবরটি শুনি। কিন্তু সেটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। কোনো বাঙালি এটা করতে পারে তা অবিশ্বাস্য ছিল কঠিন। আমরা জানতাম না সেদিন আসলে কি হয়েছিল। শুধু জানি একটি ক্যু হয়েছে, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। তখনও জানতাম না যে পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।

সেই সময়ের মিসেস গান্ধী দ্রুত আমার কাছে তথ্য পাঠান যে, তিনি আমাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিতে চান। যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো এবং মিসেস গান্ধী আমাদেরকে আশ্রয় দিতে চান। শেষ পর্যন্ত আমরা ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ আমাদের মনে হয়েছে, আমরা যদি দিল্লি যাই, সেখান থেকে দেশে ফিরতে পারব। এরপর জানতে পারব আমাদের পরিবারের কতজন সদস্য এখনও বেঁচে আছেন।

এএনআই: আপনার পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে—এই যন্ত্রণা সহ্য করলেন কীভাবে?

শেখ হাসিনা: সেটা খুবই কঠিন সময় ছিল। জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে ডেকে নিয়ে খবরটি জানালেন। খানিক সময়ের জন্য আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমি আমার বোনের কথা ভাবলাম। সে আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট। আমি শুধু ভাবছিলাম, সে এই খবরটা কীভাবে নেবে? এটা তার জন্য খুবই কঠিন ছিল।

দিল্লিতে আসার পর আমাদেরকে নিরাপত্তা বেষ্টিত একটি বাড়িতে রাখা হলো। তারাও আমাদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

এএনআই: আপনার কি মনে হয়, সেই সময়ে আপনিও টার্গেট হতে পারতেন?

শেখ হাসিনা: তেমন খবর ছিল। যারা আমার বাবা-মাকে হত্যা করেছে, পরে তারা আরও ৩টি বাড়িতে হামলা করেছে আমার আত্মীয়দের হত্যা করার জন্য। আমার বাবার ২ বোনের বাড়িতে তারা হামলা চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।

এএনআই: কতজনকে তারা হত্যা করেছে?

শেখ হাসিনা: প্রায় ১৮ জনকে তারা হত্যা করেছে। তাদের অধিকাংশই আমার পরিবারের সদস্য। সেই সঙ্গে ছিলেন গৃহ পরিচারিকা ও তাদের সন্তান, অতিথি।

এএনআই: বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ যেন আর ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেই জন্য এমন প্রচেষ্টা করা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে।

শেখ হাসিনা: ঠিক তাই। আমার সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তাকেও ছাড়েনি।

আমরা দিল্লি এলাম সম্ভবত ২৪ আগস্ট। সেখানে আমি দেখা করি মিসেস গান্ধীর সঙ্গে। তখন জানতে পারলাম যে, কেউই আর বেঁচে নেই। তিনি আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করলেন, আমার স্বামীর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করলেন। সেখানে প্রথম ২-৩ বছর অনেক বেশি কষ্ট লেগেছে, কারণ এই ঘটনাটি মেনে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র ৪ বছর, মেয়েটা আরও ছোট। তারা নানা-নানীর কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করত। বেশি কান্না করতো আমার ছোট ভাইটার কাছে যাওয়ার জন্য।

কঠিন একটি সময় পেরিয়েছি। আমরা ভাবতাম, কী করা যায়, কিছু একটা করা উচিত। এভাবেই আমরা থাকতে পারি না। তারা শুধু আমার বাবাকেই হত্যা করেনি, স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শকেই বদলে দিচ্ছে। এক রাতের মধ্যে সব বদলে গেল।

খুনিরা আমাদেরকেও খুঁজছিল। তারা চেষ্টা করছিল আমাদেরকে খুঁজে বের করতে। ভারতের পান্ডারা রোডে আমরা যখন ছিলাম, সেখানে আমাদের নামও বদলে ফেলা হয়েছিল। এটা খুবই কষ্টের যে, আপনি আমরা নিজের নাম, নিজের পরিচয় ব্যবহার করতে পারছেন না। নিরাপত্তার কারণেই সেটা করতে হয়েছিল।

এএনআই: এই সময়টিতে বাংলাদেশ থেকে কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি?

শেখ হাসিনা: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের মধ্যে আমার চাচী, ২ ভাই, বোন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তারা চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তীতে তারা কলকাতায় এসেছিলেন (দেখা করতে)। কিন্তু প্রথম ২-৩ বছর কারো সঙ্গে দেখা হয়নি।

এএনআই: আপনি ভারতে ছিলেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। শুনেছি, অনেকেই বলতেন আপনার দেশে ফেরা উচিত, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত, কিন্তু আপনি দ্বিধায় ছিলেন। আপনি সেই সময়ে রাজনীতিতে যোগ দিতে চাইতেন না।

শেখ হাসিনা: দলের বেশিরভাগ সদস্য বেইমানি করেছে, পাশাপাশি এরপর আরেকটি ক্যু হয় ৩ নভেম্বর। সেইসময় আমাদের অনেক নেতাতে হত্যা করা হয়।

প্রথম দিকে আমাদের কাছে কাউকে আসার অনুমতি দেওয়া হতো না। পরবর্তীতে আমার ২ চাচীকে আসতে দেওয়া হয়। তারা দিল্লি আসতেন, আমি একবার কলকাতা গিয়ে দেখা করেছি।

এএনআই: রাজনীতিতে যোগ দিতে চান না বা দেশে আর ফিরতে চান না— এমন কোনো দ্বিধা কি আপনার ভেতরে কাজ করেছে?

শেখ হাসিনা: আমি সব সময় নিজের দেশে ফিরতে চেয়েছি। কিন্তু এত বড় একটি দলের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমি ভাবিনি তখন। পরবর্তীতে আমি যখন লন্ডনে যাই, তখন দল গোছানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং সেই অনুযায়ী উদ্যোগ নেই। লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করি। সেখানেই ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট প্রথমবারের মতো আমি জনগণের সামনে আসি একটি সভায়। সেখানে আমি হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি জানাই। এর আগে ১৯৭৯ সালে আমার বোন সুইডেনে গিয়ে একটি সভায় যোগ দেন হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে।

আমি কখনও কোনো পদ-পদবী গ্রহণের কথা ভাবিনি। তবে গণতন্ত্রের জন্য, আইনের শাসনের জন্য এবং খুনিদের বিচারের জন্য আমি সরব ছিলাম।

খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ইনডেমনিটি অডিয়েন্স ইস্যু করে বলা হয়েছিল, এ বিষয়ে কোনো দাবি জানানো যাবে না বা কোনো মামলা করা যাবে না। খুনিদের নানাভাবে দায়মুক্তি দেওয়া একেবারেই বেআইনি। তারা যে হত্যা করেছে তা দিবালোকের মতো সত্য এবং তারাও স্বীকার করেছে যে তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

আমি এই বিষয়ে আন্দোলন শুরু করলাম। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সংসদ সদস্যের সঙ্গে আমি দেখা করি। আমরা বিচারের দাবি জানাই। নোবেল বিজয়ী শন ম্যাক ব্রাইট, ব্রিটিশ সংসদ সদস্য টমাস উইলিয়ামসসহ অনেককে নিয়ে আমরা একটি কমিশনও গঠন করি। এই কমিশনের মাধ্যমে আমরা দাবি জানাই, হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হতে হবে। টমাস উইলিয়ামস বাংলাদেশে আসার জন্য ভিসার আবেদন করেন। কিন্তু তৎকালীন সামরিক একনায়ক তাকে ভিসা দেয়নি, বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়নি।

এক দিকে আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, অপর দিকে বিচারের জন্য দাবি জানাতে হচ্ছে। বিচার পাচ্ছি না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমি আবার দিল্লি ফিরে আসি ১৯৮০ সালের শেষ দিকে।

সেই সময়ে আমার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগ সম্মেলন করে এবং আমাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago