বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়, বাড়ছে ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা

প্রতীকী ছবি | এএফপি

রাত প্রায় একটা। রাজধানীর ফার্মগেটের কাছে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভেতর থেকে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন ৩০ বছর বয়সী এক নারী। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। কে, কেন চিৎকার করছে, তা জানতে আশেপাশের থাকা লোকজনের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা গেল। যেন নিজে সমস্যায় পড়তে পারে ভেবেই তাদের এ অনীহা!

চিৎকার আরও জোরালো হয়ে উঠলে আশপাশের লোকজন খানিকটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং কী ঘটছে তা দেখার জন্য অটোরিকশার কাছে যায়। এর পরপরই ওই নারীর সঙ্গে অটোরিকশায় থাকা এক ব্যক্তি দ্রুত বের হয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।

ওই নারীর ভাষ্য, ওই ব্যক্তি জোরপূর্বক তার ছবি তুলেছিলেন এবং তিনি ওই ব্যক্তির কাছে ছবিগুলো ডিলিট করার অনুরোধ করছিলেন।

অটোরিকশাচালক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ওই ব্যক্তি ৬০০ টাকায় ২ ঘণ্টার জন্য অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে ওই নারীর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছিলেন। এরপর ফার্মগেটে তারা থামেন।

নিজেকে হাসনাহেনা (ছদ্মনাম) বলে পরিচয় দেওয়া ওই নারী জানান, হতাশাগ্রস্ত হয়ে সম্প্রতি তিনি যৌনকর্মে জড়িয়ে পড়েন। 'আমার পরিবার মনে করে আমার নাইট শিফটের চাকরি আছে। কিন্তু, আসলে আমি কী করি, সেটা জানলে তারা হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু, অর্থনৈতিকভাবে আমার পরিবারকে সাহায্য করতে এটা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।'

'ওই ব্যক্তি যে আমার ছবি তুললেন, এখন তিনি যদি সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন, তাহলে আমি কী করব? যদি শেষ পর্যন্ত আমার পরিবার সব জেনে ফেলে, তাহলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না', বলেন তিনি।

রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, সংসদ ভবন এলাকা, পল্টন, শ্যামলী, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১, মিরপুর-১৪, গুলিস্তান ও কমলাপুরসহ রাজধানীর ১০ স্থানে অনুসন্ধান করে ডেইলি স্টার দেখেছে, সম্প্রতি শহরের রাস্তায় যৌনকর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে।

যদিও এই তথ্যের পক্ষে সরকারি কোনো তথ্য নেই, তবে ১০ জন যৌনকর্মীর সাক্ষাত্কার নিয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে ডেইলি স্টার। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে এ ১০ জন যৌন পেশায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ করে মহামারির কারণে তারা এক প্রকার নিরুপায় হয়ে পড়েন।

সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এ পেশায় সদ্য আসা প্রত্যেকেই দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম এবং বিশেষ কোনো দক্ষতাও নেই। সেই কারণেই তারা যৌন পেশায় আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।

গত ৬ মাস ধরে কারওয়ান বাজার এলাকার কাছে ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন ২৫ বছর বয়সী কেয়া (ছদ্মনাম)। মূলত স্বামী তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকেই তিনি এ কাজ করেন।

পরিবারের অমতে বিয়ে করায় ও ৩ বছর বয়সী একটি শিশুকন্যা থাকায় স্বামী তালাক দেওয়ার পর পরিবারও তাকে ফিরিয়ে নেয়নি।

শুরুতে তিনি কারওয়ান বাজারে বিভিন্ন ট্রাক থেকে উচ্ছিষ্ট সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। অন্য কোনো দক্ষতাও তার ছিল না, আবার তার সন্তানের দেখাশোনা করার জন্যও কেউ ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্থানীয় দিনমজুরদের কাছ থেকে অনৈতিক কাজের প্রস্তাব পেতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি যৌন পেশায় জড়িয়ে যান।

মহাখালীর ৭তলা বস্তিতে একটি ঘরে ভাড়া থাকেন কেয়া। 'যখন আমার অর্থের প্রয়োজন হয়, শুধু তখনই আমি যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করি। ইতোমধ্যে আমার প্রতিবেশীরা আমাকে সন্দেহ করা শুরু করেছে এবং আমাকে এড়িয়ে চলছেন। গত মাসে আমার বাড়িওয়ালাও আমাকে ঘর খালি করে দিতে বলেছিলেন', বলেন তিনি।

কেয়া বলেন, 'আমি এ পেশা ছেড়ে দিতে চাই। কারণ, এ কাজের সময়েও আমাকে সঙ্গে আমার সন্তানকে নিয়ে যেতে হয়, যেহেতু তাকে দেখার কেউ নেই।' সবশেষে একটি কাজ জোগাড় করে দেওয়ার জন্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে অনুরোধ জানান কেয়া।

যেদিন ডেইলি স্টারের সঙ্গে ৪০ বছর বয়সী রহিমার (ছদ্মনাম) কথা হয়, সেদিন ছিল তার যৌন পেশায় আসার দ্বিতীয় দিন। তালাকপ্রাপ্ত রহিমার ২ সন্তান রয়েছে। এর আগে রহিমা একটি চাতাল কলে কাজ করতেন, যেখানে তিনি বছরে ৭ থেকে ৮ মাস কাজ করতে পারতেন।

মহামারি কারণে তিনি ঢাকায় আসেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু, তিনি কোনো কাজ পাননি। পরিবার ও ২ সন্তানের কথা বিবেচনা করে বাধ্য হয়েই তিনি এ পেশায় আসেন।

'পেশা সম্পর্কে জানতে পারলে আমার সন্তানেরাও আর আমার সঙ্গে থাকবে না', বলেন তিনি।

২৫ বছর বয়সী রিমার (ছদ্মনাম) গল্পটা একটু ভিন্ন। তিনি এক পুলিশ কর্মকর্তার চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন। তাদের বিয়ের নিবন্ধন না থাকায় গত বছর স্বামী মারা যাওয়ার পরেও তিনি আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

পরিবারের সবাই মনে করে যে তিনি একটি হাসপাতালে নাইট শিফটে ক্লিনার হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু, বাস্তবে চিত্র ভিন্ন।

সূত্র ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, বিভিন্ন বয়সী নারীরা ক্রমবর্ধমানভাবে যৌন পেশায় আসছেন।

বিপুল সংখ্যক যৌনকর্মী দালালদের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ক্লায়েন্টদের জন্য ওইসব দালালরা ব্যবসায়িক কার্ড ব্যবহার করে থাকেন। ডেইলি স্টার ১০ দিনে এ ধরনের ৩০টি কার্ড সংগ্রহ করেছে। বেশিরভাগ কার্ডেই একটি নতুন জায়গার কথা বলা আছে, 'মিরপুরের শেওড়াপাড়া'।

রাজধানীতে যৌনকর্মীর সঠিক সংখ্যা কত কিংবা তা বেড়েছে কি না, এ সংশ্লিষ্ট কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যান দিতে পারেনি ভাসমান যৌনকর্মীদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠনগুলো।

তবে, সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৫-২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯ হাজার ২৯৪ জন সড়ক, বাসস্থান ও হোটেলভিত্তিক নারী যৌনকর্মী ছিলেন, যাদের মধ্যে ৮ হাজার ২৩৮ জন ভাসমান যৌনকর্মী।

২৯টি যৌনকর্মী সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের (এসডব্লিউএন) সাধারণ সম্পাদক আলেয়া বেগম লিলিও একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমার সূত্রের খবর অনুযায়ী, নতুন অনেকেই এখন এ কাজে আসছেন। আমার মনে হয়, মহামারির কারণেই অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েও কোনো কাজ পাননি, আবার এখন চাকরি পাওয়াও কষ্টসাধ্য, তাই তারা এ পেশায় আসছেন।'

মুগদার ভাসমান যৌনকর্মীদের জন্য একটি ড্রপ-ইন-সেন্টারের সমন্বয়ক রিনা আকতার বলেন, 'সম্প্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা সত্যিই বেড়েছে। আগে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন যৌনকর্মী প্রতিদিন সকালে বিশ্রাম নিতে আমাদের কেন্দ্রে আসতেন। সম্প্রতি এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।'

সেভ দ্য চিলড্রেন বর্তমানে নারী যৌনকর্মীদের জন্য রাজধানীতে ৭টি ড্রপ-ইন-সেন্টার পরিচালনা করছে। তারা জানায়, তাদের কেন্দ্রগুলোতে আসা নতুন যৌনকর্মীর সংখ্যা কম। কারণ, ড্রপ-ইন-সেন্টারে গেলে পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বিধায় অনেকেই সেখানে যেতে দ্বিধাবোধ করেন।

'যদি আমাদের পরিবারের সদস্যরা বা সমাজ আমাদের প্রকৃত পেশা সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে তো তারা আর আমাদের সঙ্গে থাকবে না', বলেন কেয়া।

Comments

The Daily Star  | English

Made with US cotton? Pay less at US customs

US customs will apply a tariff rate only to the non-American portion of a product's value

10h ago