শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

‘এতো লাশ দেখে আমি চিৎকার করতে থাকি’

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে তাদের এদেশীয় সহযোগী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এর মধ্যে ঢাকার রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা অন্যতম। সে দিনের ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন রবিউল আলম।
রায়েরবাজার গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী রবিউল আলম। ছবি: স্টার

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে তাদের এদেশীয় সহযোগী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এর মধ্যে ঢাকার রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা অন্যতম। সে দিনের ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন রবিউল আলম।

রবিউল আলম বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব। একসময় বাদাম–বুট বিক্রি করেছেন, রিকশাও চালিয়েছেন। পরে মাংসের ব্যবসা করে সচ্ছলতা পেয়েছেন কিছুটা। বয়স ৬৬, একাত্তর সালে বয়স ছিল ১৪। রায়েরবাজারের এলাকায় বাসা হওয়ায় বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পরিচিত। ২০২১ বইমেলায় 'আমার দেখা রায়েরবাজার বধ্যভূমি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তেভেজা একটি বটগাছ' নামে বই প্রকাশ করেন তিনি।

১৪ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণ করে রবিউল আলম বলেন, '১৯৭১ সালে ঝিগাতলা বাবুর্চি পাড়ায় মাংসের দোকানে কাজ করতাম। দৈনিক পারিশ্রমিক ছিল ৫ টাকা। ডিসেম্বরের ৪ বা ৫ তারিখে প্রতিদিনের মতো সেদিনও যাচ্ছিলাম। ট্যানারি মোড়, বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের কাছে যেতেই দেখলাম- অনেকগুলো লোককে লাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমাকে দেখেই ডাকে, একই সারিতে বসতে বলে। সেদিন আমার সামনে ছিল আগের চেনা সুধীর বাবু। তিনি বেশ দুঃসাহসী, ও চটপটে এবং মুসলমানের সব বিধান জানা তার। আমি শুধু দু-একটি কলেমা জানি। লাইনে বসে আছি, এমন সময় একজন পাকিস্তানি অফিসার এসে সবাইকে লাইনে দাঁড় করাল এবং এক এক করে সবাইকে কলেমা বলতে বলল। কারো কারো লুঙ্গি খুলেও দেখছিল। কাউকে কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে। কাউকে লাঠি দিয়ে আঘাত, কারও পিঠে কিল-ঘুষি, আরও কত কী করছে তার ইয়াত্তা নেই। আমি শুধু চিন্তা করছিলাম, সুধীর বাবুর কী হবে?'

'এর মধ্যে সুধীর বাবু পণ করে বসে আছেন, যা হওয়ার হবে, অন্তত ২ জনকে হত্যা করবেন। মরতে তো হবেই, লুঙ্গি উঠালে আর রক্ষা নেই। সুধীরের কথা শুনে আমি ঘামছিলাম। এমন কিছু করলে আমরা যে কজন পিছনে আছি, সবাইকেই ব্রাশফায়ার করে মারবে পাকিস্তানিরা।'

'তার সঙ্গে কলেমা নিয়ে তর্ক হয়। সুধীর বাবুর উত্তরে অপমানিত বোধ করে তারা। ফলে রাইফেলের বাট দিয়ে তাকে সজোরে আঘাত করে আর মুখে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে ভাগিয়ে দেয় তাকে। আর বেলুচি আমাকে কলেমা জিজ্ঞেস করলো না, লুঙ্গি খুলে দেখলো! আমি আর সুধীর বাবু কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি বললেন, "দেখলি রবিউল, বেলুচি তো একজন মুসলমান কিন্তু হালায় নিজেই কলেমা জানে না, আর আমারে কয় কলেমা কইতে। হালা বেকুউব না।" সেদিন আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাই দুজনে।'

রবিউল বলেন, '৮ তারিখ থেকে সন্ধ্যা আইন চালু হওয়ায় কাজে যাইনি। ডিসেম্বরের ১১ তারিখ সকালে মায়ের কাছে খাবার চাইলে মা খাবার নেই বলে জানায়। ঘরে রান্নার মতো কিছু নেই। তাই রায়েরবাজারের পাশে যাচ্ছিলাম মাছ ধরতে। যেতেই রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষের লাশ দেখে চিৎকার করে উঠি। পাকিস্তানি আর্মিরা শুরু করলো ব্রাশ ফায়ার। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি।'

'তারা দৌঁড়ে এসে ধরে নিয়ে যায় কাটাসুর ক্যাম্পে। সেখানে চালানো হয় নির্যাতন। আমার বয়স বিবেচনায় তারা রাতে ছেড়ে দেয়। আমার মতো আরও অনেককে জমির সাজের্ন্ট নামে এক বাঙালী আর্মি মুক্তি দেয়,' বলেন তিনি।

রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বাইরেও বধ্যভূমির অবস্থান ছিল। সেখানে এই বটগাছের নিচে অনেককে হত্যা করে। ছবি: সংগৃহীত

'১৪ ডিসেম্বর রায়েরবাজারের পূর্ব পাশে আমাদের বাসা। হত্যার আগে মানুষের কান্নায় এলাকায় থাকা কষ্টকর ছিল। বটগাছে মানুষ ঝুলিয়ে মারত। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা দফায় দফায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। দেখার কেউ ছিল না। আর মূলত জায়গাটি ছিল ইটখোলা, ছোট ছোট খাল এবং জলাভূমিতে ভরা। যে অংশে এই গণহত্যা হয়, সেখানে যাই সকালে। দেখি ইটভাটায় অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। এতো লাশ দেখে আমি চিৎকার করতে থাকি। কাক কুকুর শিয়াল খাচ্ছে। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ও  ডাঃ এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীকে চিনেছি।

রায়েরবাজারের আশেপাশেও মাটি ছাপা ছিল লাশ, পচে মাটি ফুলে উঠলে কুকুর টেনে খেতে দেখেছি। দুর্গন্ধে থাকা দায় হয়ে পড়ছিল। ডিসেম্বরের ১৬, ১৭ ও ১৮ তারিখেও লাশ দেখেছি। পরে স্বজনরা সেই মৃতদেহ উদ্ধারের কাজে অংশ নেন। আমিও ছিলাম উদ্ধার কাজে।'

রবিউল আলম বলেন, 'রায়েরবাজারের বটগাছ ইতিহাসের একটি অংশ। কিন্তু গাছটির আশপাশে বাড়িঘর বানিয়ে দখল করে রেখেছে। খালের জায়গাও দখল করেছে অনেকেই। এর মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও রয়েছে। এই জায়গাটি উদ্ধারের দাবি জানাই আমি।'

Comments

The Daily Star  | English

Anontex Loans: Janata in deep trouble as BB digs up scams

Bangladesh Bank has ordered Janata Bank to cancel the Tk 3,359 crore interest waiver facility the lender had allowed to AnonTex Group, after an audit found forgeries and scams involving the loans.

6h ago