শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বি: সাফল্যের হাতছানি ফেলে বুলেটের সামনে

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডা. ফজলে রাব্বি। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের শোষণমুক্ত হয়ে যে মেধাবীরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, স্বাধীন দেশ গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন তাদের অন্যতম শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বি। তার সুযোগ ছিল  উন্নত দেশে আরও উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তোলার। কিন্তু সাফল্যের হাতছানি পেছনে ফেলে তিনি ছুটে এসেছিলেন দেশের মানুষের সেবা করার জন্য। ঘাতকের বুলেট তাকে বাঁচতে দেয়নি, তবে তার রেখে যাওয়া আদর্শ প্রেরণা হয়ে আছে স্বাধীনচেতা বাঙালির হৃদয়জুড়ে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডা. ফজলে রাব্বির মহান মুক্তিযুদ্ধে আসামান্য অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে পুরো জাতি। তবে নিজ শহর পাবনায় যেন তিনি অবহেলিত। তার নামে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণের দাবি থাকলেও তা এখনও পূরণ হয়নি। তার অসহায় মানুষের সেবার লক্ষ্য পূরণে পরিবার পাবনায় গড়ে তুলেছে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি ফাউন্ডেশন। তবে সেটিও অর্থাভাবে সব লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না।  

ডা. ফজলে রাব্বি ১৯৩২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবনা শহরের ছাতিয়ানি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মেধাগুণে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও সুনাম অর্জন করেন তিনি।

ছাত্রজীবন থেকেই মেধাবী ফজলে রাব্বি ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন পাস করে লেখাপড়া করার জন্য ঢাকায় চলে যান। ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার হিসাবে যোগ দেন তিনি।

এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখান থেকে তিনি ১৯৬২ সালে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করে বিলেতের মাটিতে চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই সাফল্য পান।

সে সময় তার মেধা ও কর্মদক্ষতার জন্য বিদেশের মাটিতে লোভনীয় চাকরির সুযোগ আসে। তবে ডা. ফজলে রাব্বি ছিলেন মনেপ্রাণে দেশপ্রেমিক মানুষ। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন শেষে তিনি ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

শিক্ষকতার পাশাপাশি ডা. ফজলে রাব্বি বিনামূল্যে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। তিনিই প্রথম গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ডা. ফজলে রাব্বি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছেন, তাদের খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। আর এতেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর রোষানলে পড়েন।

পাকিস্তানি সেনারা তাদের এ দেশের দোসরদের সঙ্গে নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর তাকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। রাতভর অমানুষিক নির্যাতন করে ভোরের আলো ফোটার আগেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২ দিন পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বির বোন জিনাত আরা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাব্বি তার মেধা ও কর্মগুণে বিদেশের মাটিতে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন গড়ার সুযোগ পেয়েও দেশের এবং মাটির টানে নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। বিপদ জেনেও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন, একজন সাহসী সৈনিকের মত তিনি কখনও পালিয়ে যাননি। বিভিন্ন স্থানে যখন বুদ্ধিজীবীদের ধরে হত্যা করা হচ্ছিল, তিনি নিজের জন্য এতটুকু বিচলিত হননি। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, কখনও মাথা নত করেননি।'

তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য হিসেবে তার কিছু আক্ষেপ আছে বলে জানান জিনাত আরা।

পাবনায় ডা. ফজলে রাব্বির এই বাড়িটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি ফাউন্ডেশনের অফিস হিসেবে। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/ স্টার

ডা. ফজলে রাব্বির জন্মভূমি পাবনা হলেও এখানে এখনও তার স্মৃতি ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পাবনাবাসী ২০০৮ সাল থেকে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বির নামে করার দাবি জানিয়ে আসলেও সেই দাবি পূরণের উদ্যোগ নেই।

পাবনার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল মতিন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডা. ফজলে রাব্বির নামে পাবনা মেডিকেল কলেজের নামকরণের করার দাবিতে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন করা হয়েছে। এ দাবির পক্ষে পাবনাবাসীর সই নেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছে বারবার এ দাবি জানানো হলেও তা এখনও অপূর্ণই রয়ে গেছে।'

সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও ডা. ফজলে রাব্বির পরিবারের পক্ষ থেকে ১৯৯৬ সাল থেকে পাবনায় সামাজিক কাজ শুরু করেছে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি ফাউন্ডেশন।

ডা. ফজলে রাব্বির পরিবারের সদস্য ও ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট ফজলে শাহারান বিপু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ফাউন্ডেশন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানদের বিনামূল্যে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।'

তবে অর্থের অভাবে অনেক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান বিপু। শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির স্মৃতি ধরে রাখতে তার পথ অনুসরণ করে অসহায় মানুষের জন্য নেওয়া এ  উদ্যোগের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
August 5 declared as July Mass Uprising Day

Govt declares 3 new days for nat’l observance

The interim government yesterday declared August 5 as “July Mass Uprising Day” to commemorate the student-led protests that toppled the Sheikh Hasina regime that day last year.

3h ago