একাত্তরের বধ্যভূমি: ধীরগতি আর অনিয়মে বাধাগ্রস্ত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ

‘বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজে অনিয়ম কেবল জঘন্য অপরাধই নয়, এটি শহীদদের স্মৃতির প্রতি অবমাননাও।’
rayerbazar-boddhobhumi
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ গতকাল রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ছবি: স্টার

২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণে দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু অনিয়ম ও ধীরগতির কারণে দুটি উদ্যোগই বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত পরবর্তী চার বছরে মন্ত্রণালয় সারাদেশে ১৯৩টি বধ্যভূমি খুঁজে বের করে। কিন্তু প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এরমধ্যে মাত্র ৩৫টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়।

ধীরগতির পাশাপাশি প্রকল্পের নির্মাণকাজেও অনিয়ম দেখা গেছে।

স্মৃতিস্তম্ভগুলোর অবস্থা জানতে ২০১৬ সালে ১২টি স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিনিধিদল।

তারা দেখতে পায়, এরমধ্যে ১১টি স্মৃতিস্তম্ভেরই বেহাল দশা। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভেই নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। একইসঙ্গে এগুলোর অবকাঠামোও দুর্বল। আইএমইডির প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন থেকে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভেরই ভেতরে ও চারপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বর্তমান সরকারের অধীনে দেশব্যাপী ৪০টি জেলার ১১০টি উপজেলায় ২৮০টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। চলমান এই প্রকল্পে সরকারের মোট খরচ হচ্ছে ৪৪২ কোটি টাকার মতো। এর বেশিরভাগই খরচ হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ বাবদ। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ৮০ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত থাকলেও, দুদফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রথমে ২০২৩ ও পরে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্প সূত্র গতকাল বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই প্রকল্পের অগ্রগতি ১৯ শতাংশ।

প্রকল্প পরিচালক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আমরা ৩৫টি বধ্যভূমিতে কাজ শেষ করেছি। এই বছর আরও নয়টি বধ্যভূমির কাজ শেষ করতে পারব বলে আশাবাদী।'

কিন্তু আবারও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

চলতি বছরের জুনে দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ সম্পন্ন হওয়া তিনটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করে আইএমইডির একটি দল। এরমধ্যে দুটি বধ্যভূমির কাজে অনিয়ম খুঁজে পায় তারা।

ডেইলি স্টারের হাতে আসা আইএমইডি কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, নির্মাণকাজে নিম্নমানের বালি ব্যবহার করতে দেখেছে প্রতিনিধিদল। সিলেট ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমিতে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে বর্ষায় যখন প্রতিনিধিদল সেখানে যায়, তখন বৃষ্টির পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। পিলারের প্লাস্টারেও পাওয়া গেছে সমস্যা।

প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'প্রথম পর্যায়ের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে আইএমইডির দল যখন স্মৃতিস্তম্ভগুলো পরিদর্শন করে, তখন সেগুলো নির্মাণাধীন ছিল। নির্মাণাধীন বধ্যভূমি পরিদর্শন করে তারা কীভাবে প্রতিবেদন জমা দিলো, তা আমার জানা নেই।'

পরিদর্শনকারী দলের নেতৃত্বে থাকা আইএমইডির সহকারী পরিচালক মো. জুলহাজ আলী সরকার বলেন, 'বধ্যভূমির কাজে যে ধরনের রড-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালিতেও আমরা মাটির সংমিশ্রণ পেয়েছি। আর আমার যা বক্তব্য, তা আমি জমা দেওয়া রিপোর্টেই বলে দিয়েছি। বাকিটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়।'

এ বিষয়ে প্রখ্যাত লেখক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, 'বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজে অনিয়ম কেবল জঘন্য অপরাধই নয়, এটি শহীদদের স্মৃতির প্রতি অবমাননাও।'

বড় প্রকল্পে আগ্রহী

গবেষকরা বলছেন, বধ্যভূমিতে বৃহৎ পরিসরে স্থাপনা নির্মাণ না করে ছোট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা উচিত সরকারের। এতে করে স্বল্প খরচে বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৯৬ সালে আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য হাশেম খানের করা স্মৃতিস্তম্ভের নকশাসহ একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যদি মন্ত্রণালয় বর্তমানে সে নকশার ভিত্তিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করত, তাহলে এতদিনে দেশের সব বধ্যভূমিতেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা যেত।'

'কিন্তু মন্ত্রণালয় বরাবরই বড় আকারের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে মনোযোগী', যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের পক্ষ থেকে গত পাঁচ বছরে স্বল্প খরচে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার প্রস্তাব দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয় কোনোবারই তা গ্রহণ করেনি।

গণহত্যা গবেষকরা বলছেন, বড় আকারে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলে কমিশন পাওয়া সম্ভব। ফলে কর্মকর্তারা সেদিকেই বেশি আগ্রহী।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজে কোনো অনিয়মের বিষয়ে তার জানা নেই। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Comments