আ. লীগ সংসদ সদস্য গোলাপ নিউইয়র্কে ৯টি সম্পত্তির মালিক

আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ। ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তার মার্কিন নাগরিকত্ব এবং নিউইয়র্ক সিটিতে ৯টি সম্পত্তির মালিক হওয়ার তথ্য গোপন করেছিলেন বলে একটি বৈশ্বিক সংবাদ সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক 'নেটওয়ার্ক ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)' তাদের প্রতিবেদনে বলছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক গোলাপ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে নিউইয়র্কে এসব সম্পত্তি কিনেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, '২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া জ্যাকসন হাইটের একটি আলিশান ভবনে ৫টি কনডোমনিয়াম কিনেছিলেন, ওই সময়ে যার দাম ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ কোটি টাকা)। এর কাছাকাছি কয়েকটি ভবনে তিনি আরও ৩টি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার দাম ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় ৭ কোটি টাকা)।'

'নিউইয়র্ক সম্পত্তির রেকর্ড অনুযায়ী, এসব সম্পত্তির সবই নগদ টাকায় কেনা হয়েছিল।'

'মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি কিনেছেন প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা) মূল্যে।'

গত শুক্রবারে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, '৮০র দশকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া কম বেতনের কাজ—পিজ্জা তৈরি, ওষুধের দোকানে কাজ , লাইসেন্স ছাড়া ট্যাক্সি চালাতেন—  বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা। এসব কাজ থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে এভাবে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি কেনা সম্ভব না।'

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সম্পত্তি কিনতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেননা, বাংলাদেশ থেকে সম্পত্তি কেনার জন্য বিদেশে অর্থ পাঠানোর সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত অক্টোবরে অবসর নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম আগস্টে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী ও কর্মরত কাউকে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় না।

তিনি মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও বলেন, 'বাংলাদেশে থাকা ও বাংলাদেশে অর্জিত অর্থ ব্যবহার করে বিদেশে সম্পত্তি কেনার কোনো সুযোগ নেই।'

তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিদেশে সম্পদে বিনিয়োগের জন্য কেউই বিদেশে অর্থ নিতে পারবেন না।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, '৭০এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নরওয়েতে পড়াশোনা করার পর তিনি ৮০র দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্ক চলে যান।'

প্রতিবেদন বলছে, পরের ৩ দশকে তিনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে এবং ক্ষমতায় না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে থেকেছেন। 'যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন তিনি দেশটির নাগরিকত্বও পেয়েছেন।'

ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে তার সম্পত্তি কেনা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ৫ বছর পর।

২০১৮ সালে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগেই তিনি প্রায় ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারে নিউইয়র্কে ৮টি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।

বাংলাদেশের সংবিধান কোনো বিদেশি নাগরিককে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেয় না উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাপ 'সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ৭ মাস পর ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।'

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের  সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম ওসিসিআরপিকে বলেছেন, 'যদি প্রমাণিত হয় যে মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া (নির্বাচনী) হলফনামায় বিদেশে তার সম্পদের বিষয়ে মিথ্যা বলেছেন, তাহলে সে অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।'

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে দ্য ডেইলি স্টার আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।

গতকাল নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, 'কেউ হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে এবং নির্বাচনের আগে কেউ তা চ্যালেঞ্জ করলে কমিশন তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে কেউ নির্বাচিত হয়ে গেলে এ ব্যাপারে কমিশনের কিছু করার থাকে না।'

দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে খতিয়ে দেখবে এবং আইন অনুসারে মামলা করতে পারে। যদি কোনো প্রার্থী কর না দিয়ে থাকে বা কোনো সম্পদের ঘোষণা না দিয়ে থাকে তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।

উদাহরণ দিয়ে আলমগীর বলেন, যদি কোনো ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখায় তাহলে পুলিশ ফৌজদারি মামলা করবে। ওই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে এবং সাজা হলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে।

গোলাপের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, 'বিদেশি নাগরিকরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু এটা (তার বিদেশি নাগরিকত্ব) কি প্রমাণিত? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাগরিকত্বের বিষয় নিয়ে কাজ করে। তারা আমাদের জানালে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।'

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ও একজন সিনিয়র মন্ত্রী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের খবরে আমরা বিব্রত।'

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ওসিসিআরপির প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

তিনি বলেন, 'এগুলো আইনের লঙ্ঘন, যা বাংলাদেশের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শাস্তিযোগ্য।'

তিনি আরও বলেন, 'দেরি না করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।'

'জাতীয় নির্বাচনের জন্য দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার কারণে এটিকে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবে নেওয়া উচিত। যাতে জনগণের কাছে এটা প্রমাণ করা যায় যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সাহস ও সদিচ্ছা রয়েছে', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
British Bangladeshi Labour Party lawmaker and  minister Tulip Siddiq

Tulip seeks meeting with Yunus over corruption allegations, Guardian reports

Tulip, in a letter to the chief adviser, asked for a chance to discuss the ongoing controversy during his trip to London

2h ago