‘যে তথ্য প্রকাশই করলাম না, সেটা ডিলিট করব কীভাবে?’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৩৭ হাজার নদ-নদী দখলদারের তথ্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে— এমন তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
আজ বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যে প্রকল্পের মাধ্যমে এই দখলদারদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সেখানে সঠিকভাবে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে। এই তথ্য যাচাই-বাছাই করে তারপর আমাদের ওয়েবসাইটে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করব।'
সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা তথ্য প্রকাশের পর তা ডিলিট করেছি, এমন সংবাদ সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। যে তথ্য প্রকাশই করলাম না, সেটা ডিলিট করব কীভাবে?'
'আমরা এই তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়েছি। এ পর্যন্ত ৩ জন জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে উত্তর পেয়েছি। সবার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত আসার পর এই তথ্যগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। কমিশন যাচাই-বাছাই না করে কোনো তথ্য সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে পারে না', যোগ করেন ড. মনজুর।
নদী কমিশনের তথ্য মতে, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যাচাই-বাছাই না করে দখলদারদের তথ্য প্রকাশ না করার। এই দখলদারদের তালিকা তৈরিকারীরা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) অনুসরণ করেননি, যা হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী নদী চিহ্নিতকরণের সময় অনুসরণ করা উচিত।
২০০৯ সালের হাইকোর্টের ৩৫০৩ নম্বর পিটিশনের বলা হয়েছে, ২ ভাবে জরিপ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। প্রথমত সিএস ম্যাপ অনুসারে জরিপ এবং দ্বিতীয়ত আরএস ম্যাপ অনুসারে জরিপ।
এ কারণে দখলদারদের নাম ও স্থাপনার সংখ্যা জনসমক্ষে প্রকাশ করলে আইনগত ও প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে জানায় কমিশন সূত্র।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নদী ভাঙন রোধসহ দখলদারদের তালিকা তৈরিতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ৪৮টি নদী জরিপের প্রকল্পটি ২০১৭ সালে গ্রহণ করা হয় এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। প্রকল্পটির বাজেট ছিল প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। তবে খরচ হয়েছে ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
ড. মনজুর বলেন, 'যারা এই গবেষণা করেছেন, তাদের সিএস অনুসরণ করে তালিকা তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু তারা পানি আইন-২০১৩ এবং বন্দর আইন-১৯০৮ অনুসরণ করার সহজ উপায় বেছে নিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক তথ্য তারা এর মধ্যে ঢুকিয়েছেন, এমনকি তাদের কাছে সিএস মানচিত্র এবং দখলের বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় খতিয়ান ছিল না। আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে এই তালিকাটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।'
প্রকল্পের কাজটি সঠিকভাবে করা হয়নি এবং এর জন্য ব্যয়কৃত অর্থ 'জলে গেছে' বলেও মন্তব্য করেন কমিশনের চেয়ারম্যান।
ওই সভার আলোচনা
গত ১৫ ডিসেম্বর নদী দখলদারদের তথ্য প্রকাশ করা হবে কি না, সে বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সম্মেলন কক্ষে একটি সভা হয়। সেই সভার কার্যবিবরণীর একটি অনুলিপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।
৪৮টি নদী সমীক্ষা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইকরামুল হক সভায় বলেন, 'প্রকল্পের নাব্যতার তথ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে নেওয়া হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে নদীর দৈর্ঘ্য মৌজা থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আড়িয়াল খাঁ নদী ও আত্রাই নদীর পূর্ণ সমীক্ষা করা হয়নি। করতোয়া নদী ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় একদিকের সমীক্ষা করা হয়নি।'
হাইকোর্টে নির্দেশনা মোতাবেক সিএস অনুযায়ী না করে পানি আইন-২০১৩ অনুযায়ী নদীর অবৈধ দখল বা নদীর তীরবর্তী স্থাপনার তালিকা করার বিষয়ে তিনি বলেন, 'প্রত্যেক নদীভিত্তিক প্রতিবেদনে সীমাবদ্ধতা ও সমীক্ষার তারিখ উল্লেখ করা রয়েছে।'
সভায় কমিশনের নির্বাহী পরিচালক মনজুরুল কাদের বলেন, '৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্প কর্তৃক সমীক্ষাকৃত নদীভিত্তিক প্রতিবেদনের তথ্য যেহেতু পানি আইন-২০১৩ এর ভিত্তিতে, সেহেতু জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্পের ডাটাবেজে সংযোজন ও সংশোধন করা হলেও তা ব্যবহার করা সমীচীন হবে না। পানি আইন বা অন্য কোনো আইনে যা বলা থাকুক না কেন, মহামান্য হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায় অনুসারে সিএস অনুসারে নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে অবৈধ দখলের তালিকা করতে হবে।'
সভায় কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আবদুল্লা খান বলেন, 'মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সিএস রেকর্ড মোতাবেক অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়নি বিধায় প্রকল্প কর্তৃক চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তালিকা কমিশনে প্রদেয় প্রতিবেদনে ও ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এবং তা প্রকাশ করা যাবে না।'
কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী সভায় বলেন, 'সমীক্ষা প্রকল্পের প্রতিবেদনে সেকেন্ডারি ডাটা ব্যবহার করা হয়ে থাকলে যথাযথ উপায়ে (তথ্য ব্যবহারের পাতা পাদটীকা ও প্রতিবেদনের শেষে উৎসের পূর্ণ তথ্য) উৎসের বিবরণ দিতে হবে। প্রকল্পের অডিটের জন্য সময় না থাকায় অডিটবিহীনভাবেই প্রকল্প সমাপ্ত করা হবে। ভবিষ্যতে অডিট সংক্রান্ত কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে প্রকল্প পরিচালক দায়ী থাকবেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক সিএস অনুযায়ী না করে পানি আইন-২০১৩ অনুযায়ী নদীর অবৈধ দখল বা নদীর তীরবর্তী স্থাপনার তালিকা করায় উক্ত তালিকা প্রকাশ করলে আইনগত ও প্রশাসনগত সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, '৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্প কর্তৃক সমীক্ষাকৃত নদীভিত্তিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নিকট থেকে সময়ে সময়ে প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্পের ডাটাবেজে সংযোজন ও সংশোধন করা হবে; কিন্তু উন্মুক্ত করা হবে না। ডাটাবেজ ও ওয়েবসাইটে এবং প্রিন্ট কপিতে দখল, নদীর তীরবর্তী স্থাপনা সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।'
সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্প মহামান্য হাইকোর্টে নির্দেশনা মোতাবেক সিএস অনুযায়ী নদীর অবৈধ দখল বা নদীর তীরবর্তী স্থাপনার তালিকা না করায় উক্ত তালিকা প্রকাশ করলে আইনগত ও প্রশাসনগত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নদীর অবৈধ দখল, নদীর তীরবর্তী স্থাপনার নাম, তথ্য অথবা সংখ্যা কোনোটিই প্রকাশ করা যাবে না। ডাটাবেজ ওয়েবসাইটেও উক্ত অংশটুকু বাদ দিয়ে প্রকাশ করতে হবে।
তবে প্রকল্প পরিচালক এনামুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সিএস, আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) এবং বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে) অনুযায়ী দেশের কোনো নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি।
এ জন্য আইনগতভাবে কাউকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন উল্লেখ করে তিনি জানান, পানি আইন-২০১৩ ও বন্দর আইন-১৯০৮ ছিল তার একমাত্র সম্বল।
তিনি বলেন, 'এই আইন অনুযায়ী বন্দর এলাকার বাইরে নদীর তীর থেকে ১০ মিটার এবং বন্দর এলাকায় নদীর তীর থেকে ৫০ মিটার নদীর অংশ। তবে এসব আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, উল্লিখিত মানদণ্ডের আওতায় থাকা এলাকায় যেসব স্থাপনা রয়েছে সেগুলো অবৈধ।'
তিনি বলেন, 'জেলা প্রশাসনের জরিপের মাধ্যমে নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হলেই কোনো স্থাপনাকে অবৈধ ঘোষণা করা সম্ভব হবে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি, বাকিটা কমিশনের হাতে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিষয়টির সমালোচনা করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কমিশন স্পষ্টতই দখলদারদের পরিচয় রক্ষা করে তাদের পক্ষ নিয়েছে।'
Comments