দর্শনার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত হচ্ছে বঙ্গভবন

দর্শনার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে বঙ্গভবন উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ মঙ্গলবার বিকেলে বঙ্গভবনে নবনির্মিত তোশাখানা জাদুঘরের উদ্বোধনকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আজ মঙ্গলবার বঙ্গভবনে তোশাখানা জাদুঘরের উদ্বোধন করেন | ছবি: পিআইডি

দর্শনার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে বঙ্গভবন উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ মঙ্গলবার বিকেলে বঙ্গভবনে নবনির্মিত তোশাখানা জাদুঘরের উদ্বোধনকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

তার প্রত্যাশা, বঙ্গভবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নতুন এই জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী রাশিদা খানম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকসহ অনেকে।

তোশাখানা জাদুঘরের উদ্বোধন ঘোষণার পরে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন কক্ষের স্থাপনা ঘুরে দেখেন।

বঙ্গভবনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা এ তোশাখানাকে একটি আধুনিক মানসম্পন্ন জাদুঘরে পরিণত করা হয়।

তোশাখানায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার সামগ্রী এবং ঐতিহাসিক ছবি সংরক্ষিত রয়েছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য এটি সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত থাকবে। আবার বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনেও যে কেউ তোশাখানাটি যাতে দেখতে ও বঙ্গভবন সম্পর্কে জানতে পারে সে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

এর আগে রাষ্ট্রপতি সংস্কারকৃত এয়ার রেইড শেল্টার হাউসের উদ্বোধন এবং এর বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করেন।

এয়ার রেইড শেল্টার হাউস ১৯৬৫ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত এই শেল্টারটিকে বঙ্গভবনে আসা দর্শনার্থীদের জন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংস্কার করা হলেও এর আদল পরিবর্তন করা হয়নি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আজ মঙ্গলবার বঙ্গভবনে এয়ার রেইড শেল্টারের উদ্বোধন শেষে তোশাখানা জাদুঘরের পাশে নবনির্মিত কার শেড পরিদর্শন করেন | ছবি: পিআইডি

এ সময় রাষ্ট্রপতি কার শেডও পরিদর্শন করেন। কার শেডে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের ব্যবহৃত গাড়ি প্রদর্শন করা হচ্ছে।

দেশের সর্বোচ্চ সুরক্ষিত প্রাসাদ বঙ্গভবন সম্পর্কে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। ইতিহাসের পালাবদল, রাজনৈতিক বিবর্তন আর নানা ঘটনার নীরব সাক্ষী এই ভবনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও সরকারি বাসভবন।

মুক্ত আকাশ, জলাধার আর অবারিত সবুজের সমাহারে গড়ে ওঠা এই স্থাপত্যের গোড়াপত্তন ঘটে ১৯০৫ সালে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন ঢাকার নবাব পরিবারের দিলখুশা বাগানবাড়ির দক্ষিণাংশে লেফটেন্যান্ট-গভর্নরের বাসস্থান হিসেবে অস্থায়ী লাটভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। গভর্নরের অফিস ও বসবাসের জন্য নির্মিত হয় একটি টিম্বার প্যালেস বা কাঠের প্রাসাদ।

স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে ১৯০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত অস্থায়ী গভর্নমেন্ট হাউসে প্রবেশ করেন। মূলত ওই দিন থেকেই বঙ্গভবনের যাত্রা শুরু হয়। অচিরেই ভবনটি 'দিলখুশা গভর্নমেন্ট হাউস' নামে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এটি পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রথম গভর্নর ছিলেন স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন। সে সময় 'গভর্নমেন্ট হাউস' এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় 'গভর্নর হাউস'।

১৯৬১ সালের ৯ মে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ভবনটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ছাদের কিছু অংশ ধসে পড়ে। ফলে তৎকালীন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আযম খান ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সংস্কারের পরিবর্তে একটি নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।

একই বছরের জুনে তৎকালীন গণপূর্ত বিভাগ (সিঅ্যান্ডবি) ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত কাজ শুরু করেন এবং গভর্নর আযম খান ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে ভবনের উদ্বোধন করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়; যা 'মুজিবনগর সরকার' নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করা হয়। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়।

১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর দেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যরা ২৩ ডিসেম্বর গভর্নর হাউসে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা করেন। সেই সভায় গভর্নর হাউসকে নতুনভাবে 'বঙ্গভবন' নামে নামকরণ করা হয়।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হলে তিনি ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

১৯৮৫ সালে বেশ বড় পরিসরে বঙ্গভবন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও অলংকরণের কাজে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়। অভ্যন্তরীণ নান্দনিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে সংযোজন করা হয় দুর্লভ চিত্রকর্ম।

পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সময়ে ২০১৬ সালে নির্মাণ করা হয় অত্যাধুনিক সুইমিংপুল কমপ্লেক্স। তার অভিপ্রায় অনুযায়ী ২০২১-২২ সালে বঙ্গভবনে ব্যাপক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষ, হরিণ পুকুর, গ্যালারি হল, দরবার হল, ভিআইপি অপেক্ষাগার-১, এয়ার রেইড শেল্টার, কেবিনেট হল, বঙ্গভবন তোশাখানা জাদুঘর।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় গভর্নরের নিরাপত্তার জন্য একটি এয়ার রেইড শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এয়ার রেইড শেল্টারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ায় সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ২০২২ সালে এটি সংস্কার করে পুনরায় ১৯৬৫ সালের আদলে নিয়ে যাওয়া হয়।

বঙ্গভবনের প্রাচীন মানুক হাউসকে সংস্কারের মাধ্যমে 'বঙ্গভবন তোশাখানা জাদুঘর' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে বঙ্গভবনের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রদর্শন করা হচ্ছে। ১৫০ বছরেরও বেশি পুরানো মানুক হাউসের আগে রাষ্ট্রীয় তোশাখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯ শতকে মানুক নামে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ী এখানে বসবাস করতেন।

বর্তমানে তোশাখানার বেশ কিছু উপহার সামগ্রী সংরক্ষণ ও সর্বসাধারণের দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের পাশে রাষ্ট্রীয় তোশাখানা জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়েছে। মানুক হাউসকে তোশাখানা জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় এর দেয়ালে ছোট ছোট ইট ভংগুর অবস্থায় পাওয়া যায়, যার কিছু অংশ কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সংরক্ষণ করা হয়েছে।

তোশাখানার পাশেই প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেট কার। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিরা গাড়িটি ব্যবহার করতেন। ট্রাস্কো ব্রেমেন নামে একটি জার্মান কোম্পানি নির্মিত প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেট কারটি একটি অভিজাত এবং অতি-বিরল প্রসারিত লিমুজিন যা মূলত ডব্লিউ ১২৬ মার্সিডিজ-বেঞ্জ ৫০০ এসইএল মডেলের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত।

বঙ্গভবনের অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় সাধকের মাজার, দানা দীঘি, মাজার পুকুর ও সিংহ পুকুর। সুদীর্ঘ ইতিহাস আর ইসলামি, ব্রিটিশ ও মুঘল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা এই ভবন তার স্থাপত্যশৈলীকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতীক। বঙ্গভবনের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যা আগামী প্রজন্মকে আমাদের শিকড়ের সন্ধানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে।

Comments