ডা. মালেক পেলেন সম্মান ফাউন্ডেশনের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও দেশের প্রথিতযশা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালেক সম্মান কাইন্ডনেস পুরস্কার পেয়েছেন।
গতকাল শনিবার ডেইলি স্টার ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ডা. মালেকের কন্যা অধ্যাপক ফজিলাতুন্নেসা মালেকের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও সম্মান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. রুবাইয়ুল মুর্শেদ।
ডা. মালেক শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর কাইন্ডনেসের ভূমিকা নিয়ে বলেন, 'মানুষ মানুষের প্রতি দয়া অনুভব না করলে সমাজ শান্তিপূর্ণ হয় না। কাইন্ডনেস মানুষকে মানুষের কাছে নিয়ে আসে, সেটাই সমাজের ভিত্তি।'
ডা. মালেকের কন্যা ফজিলাতুন্নেসা মালেক বাবার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণের পর বলেন, 'এই পুরস্কার গ্রহণ করে আমি অভিভূত। যে প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার দিচ্ছে, অর্থাৎ সম্মান ফাউন্ডেশন তাদের দেখেও আমি মুগ্ধ। আমার বাবা সেবাই পরম ধর্ম বলে মানেন। সেই ব্রত নিয়েই তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন ১৯৭০-এর দশকে। এরপর সেই প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়েছে।'
অনুষ্ঠানে ভুটান দূতাবাসের চ্যান্সেরি শেরাব দর্জি বলেন, 'সবাই জানেন, ভুটানের রাষ্ট্রীয় নীতি হচ্ছে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস। ১৯৭০-এর দশকে ভুটান এই নীতি গ্রহণ করে। এরপর ধাপে ধাপে তার উন্নতি হয়েছে। এর মূল কথা হলো, মানুষের সর্বাঙ্গীণ সন্তুষ্টি ও শান্তি নিশ্চিত করা।'
মানুষের নিঃস্বার্থ কাজ ও দয়ার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সম্মান ফাউন্ডেশনকে অভিনন্দন জানান শেরাব দর্জি।
গান্ধী ফাউন্ডেশনের সভাপতি এস কে সান্যাল বলেন, 'হতদরিদ্র ও অস্পৃশ্য মানুষকে অন্যরা সাধারণত প্রাপ্য সম্মান দিতে চান না। মহাত্মা গান্ধী সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত ও অস্পৃশ্য মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনিই দয়ার প্রতিমূর্তি, ভালোবাসা ও সহানুভূতির প্রতিমূর্তি। তিনি নিজের হাতে মানুষের মল-মূত্র পরিষ্কার করেছেন। অথচ যে মানুষ আমাদের মল-মূত্র পরিষ্কার করে বা যারা আমাদের বাড়িতে কাজ করে, তাদের প্রতি আমরা সম্মান দেখাই না। মহাত্মা গান্ধী মনে করতেন, সমাজের একদম শেষের সারির মানুষের কাছে যেতে না পারলে মুক্তি হবে না। আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি।'
এস কে সান্যাল আরও বলেন, 'মানুষের এখন সময় নেই, আমরা এখন চিঠি লিখি না। এমনকি কেউ মারা গেলে 'রেস্ট ইন পিস' কথাটাও পুরোপুরি লিখি না; 'লিখি আরআইপি'। এর মধ্য দিয়ে মানুষ দয়া হারাচ্ছে।'
সম্মান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. রুবাইয়ুল মুর্শেদ বলেন, 'কাইন্ডনেস বা দয়ার শক্তি অপরিসীম। এক সময় দয়াকে মানুষের দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করা হতো, কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই; বরং দয়া মানুষের শক্তি। এই শক্তি ছাড়া মানুষ জীবনে সুখী হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, 'বিশেষ করে কোভিডের পর বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের সুখের সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক আছে।'
সুখের প্রসঙ্গে ডা. রুবাইয়ুল মুর্শেদ ভুটানের উদাহরণ টেনে বলেন, 'ভুটান মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাব করে না। তারা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস বা জিএনএইচ বা মোট জাতীয় সুখের হিসাব করে। অর্থাৎ তারা বস্তুগত উন্নতির চেয়ে আত্মিক উন্নতিতে বেশি জোর দেয়। ভুটান আমাদের সবার জন্য উদাহরণ হতে পারে।'
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জনস্বাস্থ্যবিদ আহমেদ মুশতাক রাজা চৌধুরী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
বিদেশি অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত হরিজন সেবক সংঘের সভাপতি শঙ্কর কুমার সান্যাল, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ সংস্কারক সুভাষ মণি সিংহ প্রমুখ।
ডা. মালেকের সঙ্গে জাহিন আহমেদ, জোগেশ চন্দ্র রায় ও সুভাষ মণি সিংহকেও পুরস্কার দেওয়া হয়। জাহিন আহমেদ ২০১৮ সালের নভেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন। জোগেশ চন্দ্র রায় মৃত্যুবরণ করেন ২০২০ সালের নভেম্বরে। কিন্তু, করোনার প্রকোপের কারণে কয়েক বছর পুরস্কার দেওয়া হয়নি। সে জন্য এ বছর তাদের পুরস্কৃত করা হয়।
সুভাষ মণি সিংহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কালিমপংয়ের একজন ব্যবসায়ী। তিনি দার্জিলিংয়ের চা বাগানের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করছেন। সেই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
পুরস্কার গ্রহণের পর সুভাষ মণি সিংহ বলেন, 'আমি পাহাড়ি অঞ্চলে কাজ করি। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই খুব দরিদ্র। ভারত সরকারের নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেখানকার মানুষ এত দরিদ্র যে, সেখানে যতে পারে না। কলকাতাও তাদের কাছে অনেক দূর। তাই আমি কালিংপংয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ নিই। সেখানে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ চলছে।'
অনুষ্ঠানে সমাপণী বক্তৃতায় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, 'সম্মান ফাউন্ডেশন যে কাজ করছে, তা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করেন, তাদের আমরা আগে চাকর বলতাম, এখন হেল্পিং হ্যান্ডস বলি। কিন্তু তাতে মানসিকতার পরিবর্তন কতটা হলো, সেটাই দেখার বিষয়। রুবাইয়ুল মুর্শেদ এই মানুষদের নিয়ে কাজ করছেন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা।'
Comments