চা শ্রমিকদের সাদাকালো জীবনে সম্প্রীতির রঙিন উৎসব ‘ফাগুয়া’

সবুজ চা বাগানের শ্রমিকদের অবহেলিত জীবনে অন্যতম উৎসব রঙ পরব বা ফাগুয়া উৎসব। এ উৎসব যেন বর্ণ-গোত্রের সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নেয়, যেন এক মিলনমেলা।
ফাগুয়া
ফাগুয়া উৎসবে রঙের খেলা। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

সবুজ চা বাগানের শ্রমিকদের অবহেলিত জীবনে অন্যতম উৎসব রঙ পরব বা ফাগুয়া উৎসব। এ উৎসব যেন বর্ণ-গোত্রের সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নেয়, যেন এক মিলনমেলা।

বাংলাদেশের চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থাকলেও, চা শ্রমিকদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতিতে একেকটি চা বাগান একেকটি দেশের মতো। তবে ফাল্গুনের এই 'ফাগুয়া' উৎসবে বাগানে সবাই একত্রিত হয়ে এক রঙের উৎসবে পরিণত করেন।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের কাছে ফুলছড়া চা বাগানে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায় ও সমাজের অন্যান্য অংশের নেতাদের একত্রিত করতে ফাগুয়া উৎসবের আয়োজন করা হয়। অবহেলিত শ্রমিক জীবনে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষায় শনিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত এই উৎসব চলে।

ফাগুয়া
ফাগুয়া উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

দরিদ্র অথচ মেহনতি চা সম্প্রদায়ের ফাগুয়াকে আরও রঙিন করতে ফুলছড়া ফুটবল মাঠে তৃতীয় বারের মতো ফাগুয়া উৎসব আয়োজন করে ফাগুয়া উৎসব উদযাপন পরিষদ। 

উৎসবের শুরুতেই আবিরের সঙ্গে রঙের খেলায় মেতে ওঠে নানা বয়সের হাজার হাজার নারী-পুরুষ। সবুজ চা বাগানের হৃদয় কিছুক্ষণের জন্য লাল হয়ে যায়। উপস্থিত ছিলেন দেশি-বিদেশি হাজার দর্শক।

চা বাগানের জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও ঐতিহ্যের প্রতীক ঘণ্টা বাজিয়ে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান।

চা শ্রমিকরা জানান, ফাগুয়া ছিল চা বাগানের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে এবং তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় সহায়তা করবে।

ঘণ্টা বাজিয়ে ফাগুয়া উৎসবের উদ্বোধন। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

উৎসবে বিভিন্ন সংস্কৃতির অন্তত ৩০টি পরিবেশনা ছিল। পত্রসওরা, নৃত্যযোগী, চড়াইয়া নৃত্য, ঝুমুর নৃত্য, লাঠিনৃত্য, হাড়িনৃত্য, পালানৃত্য, ডং ও নাগরে, ভজনা, মঙ্গলা নৃত্য, হোলিগীত, নিরহা ও করমগীত উপভোগ করে আগতরা।

উৎসবে আগত শান্তি কৈরি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশওয়ালী হিসেবে আমি প্রথম বিরাহা গীত দেখলাম। আমি কয়েকবার বিভিন্ন উৎসব দেখেছি। আজ আমি আমার জীবনে প্রথমবারের মতো ফাগুয়া উৎসব দেখলাম।'

কানিহাটি চা বাগানের চা শ্রমিক নেতা সিতারাম বীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক সংকটের মধ্যেও মাত্র ১৭০ টাকা দিয়ে পরিবার চলে। কিন্তু বছরের কোনো না কোনো সময়ে আমরা তা ভুলে যাই শুধু আনন্দের জন্য। শত অভাবেও ফাগুয়া উৎসবে আমরা পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটানোর চেষ্টা করি।'

গত ছয় বছর ধরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'ঊষা'র উদ্যোক্তা নিগাত সাদিয়া। তিনি নিজেও লাক্কাতুরা চা বাগানের শিশুদের একটি দল নিয়ে এসেছিলেন ফাগুয়া উৎসবে।

ফাগুয়া
ফাগুয়া উৎসবে আগত দেশি-বিদেশি অতিথিরা। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

ডেইলি স্টারকে সাদিয়া বলেন, 'চা বাগানে যে এত নৃত্যগীতের সমাহার এখানে না এলে আমার জানা হতো না। বীরহা আমি প্রথমবার দেখলাম।'

উৎসব আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ও কালিগাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চা শ্রমিকদের জন্য এটি একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। আমরা সবসময় চেষ্টা করি চা বাগান থেকে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নাচ ও গান এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করার। আশা করছি আগামী বছর ফাগুয়া উৎসব আরও বড় আয়োজন হবে।'

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, 'চা বাগানের সংস্কৃতি যেন কোনোভাবেই বিলুপ্ত না হয়, সেজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ফাগুয়া উৎসব যেন সবসময় পালিত হয়, সেজন্য আমরা প্রত্যেকবার আয়োজকদের পাশে দাঁড়াই। 

উৎসবে ভারতের সহকারী হাইকমিশনার নীরজ কুমার জায়সওয়াল গেস্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, 'এ রকম বিভিন্ন নাচ-গান একসঙ্গে দেখে আমি অভিভূত। আমি বিশ্বাস করি চা বাগানের সংস্কৃতি এ অঞ্চল তথা দেশের সম্পদ। এটি অনুশীলন এবং রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।'

Comments