দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ: হাইকোর্টের আদেশের পরও তদন্ত শুরু হয়নি

তথ্য লুকিয়ে ৪৫৯ জন বাংলাদেশি দুবাইয়ে মোট ৯৭২টি আবাসন সম্পদের মালিক হয়েছেন। এজন্য তারা ব্যয় করেছেন ৩১৫ মিলিয়ন ডলার।

দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির মালিকানাধীন আবাসন সম্পদ কেনার বিষয়ে তদন্ত করতে গত ১৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক আদেশ দিলেও তদন্তকারী সংস্থাগুলো এখনও কোনো কাজ শুরু করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সি৪এডিসি) গত বছরের মে মাসে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উপসাগরীয় দেশগুলোতে মূলত পাচার করা অর্থ দিয়ে আবাসন সম্পদ কেনার বিষয়টি তুলে ধরলে এটা সামনে আসে। 

তথ্য লুকিয়ে ৪৫৯ জন বাংলাদেশি দুবাইয়ে মোট ৯৭২টি আবাসন সম্পদের মালিক হয়েছেন। এজন্য তারা ব্যয় করেছেন ৩১৫ মিলিয়ন ডলার।

এসব সম্পদের মধ্যে ৬৪টি দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা দুবাই মেরিনা ও ১৯টি পাম জুমেইরাহতে অবস্থিত। যেখানে অন্তত ১০০টি ভিলা ও কমপক্ষে ৫টি ভবনের মালিক বাংলাদেশি বলে জানা গেছে।

চার থেকে পাঁচ জন বাংলাদেশি প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক। যদিও প্রতিবেদনে কারো পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

এ বিষয়ে একটি বাংলা দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত ১৫ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাংলাদেশ ফিন্যানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার আদেশ দেন হাইকোর্ট।

তবে এসব সংস্থা সংস্থা বলছে আদালতের আদেশের লিখিত কপি না পাওয়ায় তারা তদন্ত শুরু করতে পারেনি। তবে আগেও দেখা গেছে হাইকোর্টের আদেশ না পেলেও গণমাধ্যমের সংবাদের ওপর ভিত্তি করে এসব সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

২০২০ এবং ২০২১ সালে দুদক তাদের প্রাথমিক তদন্তের উৎস হিসেবে গণমাধ্যম থেকে ২১৬৭ প্রতিবেদন বেছে নিয়েছিল

একইভাবে, অন্যান্য সংস্থাগুলোও মিডিয়া রিপোর্ট, নথি দেখানোর ভিত্তিতে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত পরিচালনা করেছে।

তবে দুবাইয়ের তদন্তের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।

সিআইডির সিনিয়র পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পত্তির বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশের কোনো অনুলিপি তারা এখনও পাননি।

তিনি বলেন, আদেশ পেলে আমরা কাজ শুরু করব।

বিএফআইইউর এক কর্মকর্তাও একই কথা বলেন।

এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের মহাপরিচালক খায়রুল ইসলাম বলেন, তিনি কয়েকদিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন এবং বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।

দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, তিনি গণমাধ্যমে প্রতিবেদনটি দেখেছেন। তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সচিবের কাছে যেতে বলেন।

যোগাযোগ করা হলে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদালতের লিখিত আদেশ না পাওয়ায় তদন্ত শুরু করা যায়নি এটি খুবই দুর্বল কারণ ও হতাশাজনক বিষয়। 
তিনি বলেন, আদালতের কথা বিবেচনা না করে সংস্থাগুলোকে নিজেদের উদ্যোগেই এটি করা উচিত ছিল।

এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা উদ্বেগের জন্ম দেয় বলেন তিনি। 

'এটি কি পেশাদারি দক্ষতার অভাব? নাকি তাদের যৌথ সাংগঠনিক ক্ষমতার তুলনায় খুব বেশি কাজ? নয়তো নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব? নাকি এটাই কঠিন বাস্তবতা যে অর্থপাচারের এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সরকারি সংযোগের যে কোনো মানদণ্ডে- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুবই শক্তিশালী?

হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও অর্থপাচারের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিষয়ে এধরনের নিষ্ক্রিয়তা এই বার্তাই দেয় এই ধরনের অপরাধীরা দায়মুক্তির যোগ্য, তিনি বলেন।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই ধরনের সংস্থাগুলো যদি কোনো ব্যক্তির পরিচয় ও মর্যাদা দ্বারা প্রভাবিত হয় তবে তা দুর্নীতি এবং বিশেষ করে অর্থপাচারকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

গত কয়েক বছর ধরে, হাইকোর্ট একাধিকবার তদন্ত সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তার জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

গত বছরের ৬ মার্চ এই বিষয়ে একটি রিট আবেদনের শুনানির সময়, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছিলেন, এটি (দুদক) যদি অর্থপাচার বন্ধ করতে ব্যর্থ হয় তবে এটি দুঃখজনক। দয়া করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আমাদের নির্দেশনা মেনে চলুন। বাংলাদেশের জনগণ মেধাবী ও পরিশ্রমী। দুর্নীতি নির্মূল করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সংসদের নতুন বছরের অধিবেশন চলাকালীন, জাতীয় পার্টির দুই সংসদ সদস্য অর্থ পাচার বন্ধে সরকারের ব্যর্থতার জন্য তীব্র সমালোচনা করেছেন।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেছেন, তিনি অসহায় বোধ করেন যখন কোটি কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হলেও শেখ হাসিনার মতো শক্তিশালী সরকার কিছুই করে না।

আরেক জাপা এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ অভিযোগ করেন, আর্থিক খাতে অনিয়মের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই।

তিনি বলেন, 'আমরা শুনেছি কেউ ১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়েছে। অন্যদিকে, সামান্য ঋণের জন্য কৃষকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারের এ বিষয়ে ভাবা উচিত।'

সি৪এডিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্থিক খাত এবং রিয়েল এস্টেট পাচারকৃত অর্থের প্রধান খাত।

দুবাইয়ে যেসব বাংলাদেশি সম্পত্তির মালিক, তাদের মধ্যে ৩৩২ জন পুরুষ।

দুবাইয়ের বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট মালিকদের মধ্যে ৩১৮ জনের বয়স ৩৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, ৪২ জনের বয়স ৩৪ বছরের কম এবং ৯৭ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি।

Comments