ক্লান্ত নদীর কথকতা

খুলনার হরি নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

জীবনানন্দ দাশ নদীকে ভালোবেসেছিলেন প্রিয় মানুষের মতোই। আর মানুষের মতোই 'অনুভূতিপ্রবণ' নদীকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'কোন কথা সারাদিন কহিতেছে অই নদী? এ নদী কে?- ইহার জীবন হৃদয়ে চমক আনে।'

নদীমাতৃক বাংলাদেশে মানুষের জীবনও নদীকেন্দ্রিক। এখানকার হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতেও রয়েছে নদীর প্রভাব। এখানে নদী ও জীবন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদী এখানে দেশ ও মানুষের মায়ার জননী, জীবন্ত স্বত্তা।

এই জনপদ একসময় পরিচিত ছিল ১ হাজার ৩০০ নদীর দেশ হিসেবে। বর্তমানে সে অবস্থান আর নেই। ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীসহ এখন দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০০টির কিছু বেশি।

ভদ্রা নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

মানুষ নদী হত্যায় নানা কৌশল নিয়েছে। নদীকে ঘিরে রাষ্ট্রের অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি কেউ কেউ সরাসরি দখলের মাধ্যমে নদীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত করছেন। কেউবা নানাবিধ বর্জ্য ফেলে দূষণের মাধ্যমে নদীকে ভাগাড়ে পরিণত করছেন। এ কারণে অনেক নদী তার স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

ভদ্রা নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

নদী হারানোর এই ব্যাথা টের পাওয়া যায় জীবনানন্দের 'নদী' কবিতার আরেকটি পঙতিতে। সেখানে তিনি লেখেন, 'মানুষের মন থেকে নদীরা হারায়, শেষ হয়।' আবার তার বিখ্যাত 'পরিচায়ক' কবিতায় পাওয়া যায়, 'এই দিকে বিকলাঙ্গ নদীটির থেকে পাঁচ-সাত ধনু দূরে/মানুষ এখনো নীল, আদিম সাপুড়ে:/রক্ত আর মৃত্যু ছাড়া কিছু পায় নাকো তারা খনিজ, অমূল্য মাটি খুঁড়ে।'

বাংলাদেশের অন্য বিভিন্ন এলাকার মতোই দক্ষিণাঞ্চলের অনেক নদী এখন মৃতপ্রায়। লবণাক্ত পানি থেকে ফসলি জমি রক্ষায় ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকায় ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়, যা জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এখানকার অনেক প্রধান প্রধান নদী-উপনদীসহ সংযুক্ত খালগুলোর পানির প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে।

এতে পলি জমে দ্রুত নাব্যতা হারাতে থাকে এই অঞ্চলের নদীগুলো। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে এখানকার মানুষ ও তাদের জীবিকা এবং প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঁধ নির্মাণের আগে সাগরের জোয়ারের সঙ্গে যে পলি আসতো, তা এসব নদী-খালের মাধ্যমে লোকালয়ের নিচু জমিগুলো উঁচু করত। অবশিষ্ট পলিমাটি ভাটার টানের নদী দিয়েই আবার নেমে যেত। দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে বছরে প্রায় ১০৬ কোটি মেট্রিকটন পলি প্রবাহিত হয়, যা একসময় নদীসংলগ্ন নিচু ভূমি, কৃষিজমি ও বসতভিটায় জমা হতো।

শোলমারি নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

তবে বেড়িবাঁধের নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি উজানে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি এখন জমা হচ্ছে নদীতে। আর এতে প্রাণ হারাচ্ছে নদীগুলো। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে। পানি ও মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ও পরিধি বাড়ছে। মিষ্টি পানির আধারগুলো দখল করে নিচ্ছে লবণ পানি। জীববৈচিত্র্যে (ইকোসিস্টেম) ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বসতবাড়ি ও ফসলি জমিতে তৈরি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সমস্যা।

চিলা নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুসারে, গত ২ দশকে দক্ষিণাঞ্চলের ৫০টির বেশি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক নদী একেবারে শুকিয়ে গেছে। অস্তিত্বহীন হয়েছে হামকুড়া, মরিচ্ছাপ, ঘ্যাংরাইল, ভদ্রা শালতা, হিসনা, কুমার, মুক্তেশ্বরী, হরি ও শ্রী নদী। আঠারবেকি নদীর এখন ৫০ ভাগই মৃত। বেতনা, নবগঙ্গা, চিত্রা, কাজিবাছা, শালতা, কাকশিয়ালী, পশুরসহ খরস্রোতা নদীগুলোর অবস্থাও বিপন্ন।

ভদ্রা নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

দক্ষিণাঞ্চলের কুমার, নবগঙ্গা, চিত্রা, ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতীসহ অসংখ্য নদীর উৎসমুখ মাথাভাঙ্গা নদী। আর মাথাভাঙ্গা নদীর উৎসমুখ পদ্মা। এই মাথাভাঙ্গা নদীতে উজানের পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর উপর।

ভদ্রা নদী। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এ ছাড়া, বিভিন্ন নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ইটভাটার মালিকরা নদীতে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট পুকুর তৈরি করেছেন। এভাবে বাঁধ দেওয়ায় নদীর স্রোত কমে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে গতিপথ।

হামকুড়া। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

সম্প্রতি দক্ষিণের খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মৃতপ্রায় ও বিপন্ন এই নদীগুলোর ছবি তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী হাবিবুর রহমান।

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

1h ago