গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

'এই শিশুদের যেমন কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, ঠিক তেমনি এই শিশুরা পুষ্টিকর খাবারও খেতে পায় না। একই সঙ্গে মিলছে না তাদের চিকিৎসা সহায়তাও।'
‘গৃহকাজে নিয়োজিত শিশুর সুরক্ষা ও অধিকার: বিদ্যমান আইনি বাস্তবতা’ শীর্ষক সংলাপ গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: স্টার

গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছে। এই শিশুদের যেমন কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, ঠিক তেমনি এই শিশুরা পুষ্টিকর খাবারও খেতে পায় না। একই সঙ্গে মিলছে না তাদের চিকিৎসা সহায়তাও। দেশের বিদ্যমান শ্রম, শিশু কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মাধ্যমেও এই শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। গৃহকাজে নিযুক্ত শিশুরা একদিকে যেমন পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে না। তেমনি নাগরিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

'গৃহকাজে নিয়োজিত শিশুর সুরক্ষা ও অধিকার: বিদ্যমান আইনি বাস্তবতা' শীর্ষক এক সংলাপে এমন মন্তব্য করেছেন শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাব সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংলাপটির আয়োজন করে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি), শাপলা নীড় ও এডুকো বাংলাদেশ।

সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের ডিপুটি স্পিকার ও শিশু অধিকার বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু। সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিশু অধিকার বিষয়ক সংসদীয় ককাসের ভাইস চেয়ারম্যান আরমা দত্ত, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান, সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ।

সংলাপের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে শাপলা নীড় বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমোকো উচিয়ামা বলেন, 'বাংলাদেশে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ দান পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ। অথচ এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫-১০ বছর বয়সী অসংখ্য শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এই শিশুরা একদিকে যেমন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, অন্যদিকে কাজের সামান্য ভুলত্রুটির দরুন তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে ঠিক তেমনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যমকেও সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যদি তা করা যায় তবেই শিশুশ্রম নির্মূল করা সম্ভব হবে।'

আয়োজিত সংলাপের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এডুকো বাংলাদেশের চাইল্ড লেবার এলিমিনেশন ম্যানেজার আফজাল কবির খান। আলোচ্য বিষয়ের ওপর উপস্থাপনা করেন সরফুদ্দিন খান।

মূল প্রবন্ধে আফজাল কবির খান বলেন, 'ইতোমধ্যে এএসডি, শাপলা নীড় ও এডুকো বাংলাদেশ সমন্বিতভাবে 'গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন ২০২২' শীর্ষক একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে। যেখানে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের গৃহকর্মে নিযুক্ত না করার বিষয়টি উল্লেখ করে শিশুদের সর্বোচ্চ সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি সরকার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে ৩৮টি কাজকে চিহ্নিত করেছে অথচ এখানে গৃহকাজে নিযুক্ত শিশুদের এই তালিকায় আনা হয়নি। গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আইনের খসড়া পূর্ণাঙ্গভাবে অনুমোদিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে শিশু অধিকার বিষয়ক সংসদীয় ককাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।'

সরফুদ্দিন খান তার বক্তব্যে বলেন, 'বর্তমানে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই নারী। ২০০৭ সালে আইএলও ইউনিসেফের সার্ভেতে দেখা গিয়েছিল প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশু গৃহকর্মে নিযুক্ত ছিল। ১৬ বছর পর সে সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এই শিশুরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এরা যে ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার মধ্যে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা, নিম্নমানের পরিবেশে থাকা, ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া, বিপদজনক পরিবেশে কাজ করা অন্যতম। এছাড়া অনেক শিশুই প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নিপীড়নেরও শিকার হচ্ছে।'

সংলাপে এসএসডির কর্মসূচি পরিচালক হামিদুর রহমানের সঞ্চালনায় আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন মো. মাহবুবুল হক, গুড নেইবারসের পার্টনারশিপ ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান আনন্দ কুমার দাস, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সৈয়দা আহসানা জামান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের শিল্পী শর্মা, অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের সুপারভাইজার সৈয়দ শাহিনুর রহমান প্রমুখ।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন মো. মাহবুবুল হক তার বক্তব্যে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোনো শিশু রাস্তায় থাকবে না, কিন্তু আমরা এখনো অসংখ্য শিশুকে রাস্তায় দেখছি। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোনো শিশু নিয়োজিত থাকবে না, কিন্তু আমরা এখনো দেখছি অসংখ্য শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল ২০২৫ সালের মধ্যে কোনো শিশুই শিশুশ্রমে নিয়োজিত থাকবে না। এখন ২০২৩ সাল, দু বছরের মধ্যে এটি করাও সম্ভব হবে না। আমরা যারা উন্নয়নকর্মীরা আছি তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ এবং অনুরোধ করতে পারি। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার কেন এই বিষয়ে ব্যর্থ হচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার। আমরা অনুরোধ করব শিশু বিষয়ক যে আইনগুলো আছে সরকার সেগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে।'

সংলাপে শিশু অধিকার বিষয়ক সংসদীয় ককাসের ভাইস চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, 'মহিলা এবং শিশু দুটি আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়াটা উচিত। আমরা বহুদিন ধরে এটি চাইছি। যদিও এখনো তা করা যায়নি। তবে আমি আশাবাদী নিকটেই এটি হয়ে যাবে। দেশে শিশু বিষয়ক বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে, কিন্তু আইনের পরিপূর্ণ প্রয়োগ না থাকায় এই গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সরকার এবং সিভিল সোসাইটি উভয়কেই এক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আমরা যারা সিভিল সোসাইটি থেকে আসছি, আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত আমরা এই বিষয়ে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি। 'গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুরা প্রতিনিয়ত দৈহিক ও শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছে। ঠিক কতো সংখ্যক বাড়িতে শিশুরা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে এবং কত সংখ্যক শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আমরা জানি না। এজন্য সোশ্যাল ওয়ার্কার বা ভলান্টিয়ার তৈরি করে আমাদের সর্বত্র সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।'

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান বলেন, 'গৃহকাজে নিযুক্ত শিশুদের মধ্যে অনেকেই ভীষণ প্রতিভাবান থাকে। কিন্তু যথোপযুক্ত পরিচর্যা এবং সুযোগ না থাকায় এই শিশুরা দ্রুতই সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। গৃহকাজে নিযুক্ত এই শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এই সমস্ত বিষয়ে আমরা যদি খেয়াল করি তাহলেই শিশু অধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সরকার যত চেষ্টাই করুক না কেন, সরকারের একার পক্ষে এটি নজরদারি করা সম্ভব হবে না। এজন্য পরিপূর্ণ সমন্বয় প্রয়োজন।'

শিশু অধিকার বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি ও ডিপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু তার বক্তব্যে বলেন, 'গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুদের উপর নজরদারি ভীষণভাবে প্রয়োজন। শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। আগামীতেও নেবে। তবে সরকারের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিলে হবে না। যার যার জায়গা থেকে এই শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।'

অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এম এ করিম বলেন, 'দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য নীতিমালা থাকলে হবে না। এই নীতিমালা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন না করা গেলে কোনো প্রকার কাজই হবে না। ঠিক কত ঘরে এই শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে সে পরিসংখ্যানও আমাদের কাছে নেই। আমরা কেবল তখনই জানি যখন তা আলোচিত হয় কিংবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নয়তো পুরো বিষয়টিই চাপা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে এই শিশুদের সুরক্ষার জন্য আমাদের কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেই। যদি আমরা সমন্বিত ভাবে উদ্যোগ নিই তবে গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে।'

Comments