সিপ্লাস টিভিসহ ৬ ‘আইপিটিভি’র অফিস সিলগালা, পক্ষে-বিপক্ষে যেসব আলোচনা

ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অফিস সিলগালা করে দেওয়া অনলাইন চ্যানেল 'সিপ্লাস টিভি' নিয়ে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। অফিস সিলগালা ও ক্যামেরা জব্দ করলেও 'সিপ্লাস টিভি'র ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেল এখনো সচল রয়েছে।

গত রোববার দুপুরে লাইসেন্সবিহীন সিপ্লাস টিভি, সি ভিশন, দৈনিক অর্থনীতি, ২৪ টিভি, এসবি টিভির অফিসে অভিযান চালায় ২টি ভ্রাম্যমান আদালত।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার দুপুরে 'চট্টলা ২৪ টিভি'র অফিসেও অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অফিস সিলগালা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের টিভি-২ শাখার নির্দেশনা মোতাবেক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এই অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানিয়েছেন সিনিয়র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ লঙ্ঘন করে তথ্য-উপাত্ত ও কনটেন্ট সম্প্রচার করে আসছিল এই অনলাইন চ্যানেলগুলো। এগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মানুষ ও গণ্যমান্য ব্যক্তির চরিত্রহনন, ব্ল্যাকমেইলিং করে চাঁদাবাজি এবং অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে।

অনলাইন চ্যানেল বা অনলাইন টিভিগুলো পোর্টাল-ব্লগের তথ্য-উপাত্ত, কনটেন্ট প্রচার, প্রকাশ ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে দি সেন্সরশিপ অব ফিল্মস আইন ১৯৬৩; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন-২০০১; কপিরাইট, ট্রেডমার্কস, প্যাটেন্টস ডিজাইনসহ দেশের প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইন-বিধি বিধান লঙ্ঘন করে আসছে বলে অভিযোগ করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

অবৈধ হিসেবে সিলগালা করে দেওয়া হলেও নগরীর ওয়াসা মোড়ে অবস্থিত সিপ্লাস টিভির অফিসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসেছেন এবং নানাভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে সরব ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া, সংবাদ সংগ্রহের জন্যও এই অনলাইন টিভির কর্মীরা প্রয়োজনীয় সব জায়গায় গিয়েছেন।

২০১৬ সাল থেকে চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় যাত্রা শুরু করে সিপ্লাস টিভি। www.cplusbd.net ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে সংবাদ প্রকাশ করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপর এর ডোমেইন বদলে www.cplustv.news নামে ওয়েবসাইট চালু করে তারা। ইউটিউবে বর্তমানে ১৯ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে তাদের। অ্যান্ড্রয়েড প্লাটফর্মেও তাদের অ্যাপ রয়েছে, যেখানে এটিকে অনলাইন টিভি হিসেবেই বলা হয়েছে।

২০১৯ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের টিভি-২ শাখার গঠিত আইপিটিভির সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছিল। এই কমিটির ৯ নম্বর সদস্য ছিলেন সিপ্লাস টিভির সম্পাদক আলমগীর অপু।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে রাখার জন্য সেই সময় তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদকে ফেসবুকে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন আলমগীর।

তবে, শুরু থেকে নিজেদের অনলাইন টিভি হিসেবে বিভিন্ন স্থানে পরিচয় দিয়ে এলেও অভিযানের পর একে আইপিটিভি বলতে নারাজ সিপ্লাসের এডিটর-ইন-চিফ আলমগীর অপু। অভিযানের পর এক ফেসবুক পোস্টে তিনি দাবি করেছেন, এটি সোশ্যাল মিডিয়া এবং ২০১৬ সাল থেকেই ট্রেন্ডিং মিডিয়া হিসেবে কাজ করছে।

তিনি লিখেছেন, সিপ্লাস টিভি আইপি টিভি নয়। এটি সোশ্যাল মিডিয়া। তিনি অভিযোগ করেন, 'আমরা নিউজ পোর্টালের জন্য আবেদন করেছিলাম। অনেককেই অনুমোদন দেওয়া হলেও, সকল পেপার থাকা সত্ত্বেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। অপমানের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কোনো চিঠি দেওয়া ছাড়াই।'

আলমগীর অপু ফেসবুকে এই দাবি করলেও নিজের লিংকডইন অ্যাকাউন্টে সিপ্লাস টিভিকে তিনি নিজেই অনলাইন টিভি হিসেবেই বলেছেন।

আলমগীর অপু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আইপিটিভির জন্য আবেদন করেছিলাম, সেটি হয়নি। আমার সিপ্লাসবিডি ডোমেইন আগের বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর আমরা সরাসরি সংবাদ প্রকাশ করা বন্ধ করে দেই। আমরা অনলাইন টিভিও না আইপিটিভিও না, বর্তমানে আমরা ইউটিউব ও ফেসবুকে কনটেন্ট বানাচ্ছি।'

'বাংলাদেশে এখন ইউটিউব ও ফেসবুকের জন্য কোনো আইন নেই। আমার ক্ষেত্রে কোনো আইন প্রযোজ্য হবে না। রাষ্ট্রীয় গুণ্ডামি করে অন্যায়ভাবে আমার অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবো,' বলেন তিনি।

কোনো নোটিশ না দিয়ে ঈদের আগে এভাবে অভিযান পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের বেকার করার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ জার্নালিস্ট ইন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া (বিজেআইএম) নামে একটি সংগঠন।

চট্টগ্রামে কর্মরত একাধিক সিনিয়র সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ঈদের আগে এভাবে অভিযান চালিয়ে অফিস বন্ধ করা উচিত হয়নি। তাদের যদি কোনো ব্যত্যয় থাকে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। প্রতিষ্ঠানটিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হতো।

তারা আরও বলছেন, সিপ্লাস অনলাইন টিভি হিসেবেই সব জায়গায় পরিচয় দিয়ে এসেছে। সিলগালা করার পর আইনি ঝামেলা এড়াতে তারা এখন নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে দাবি করলে কেমন হয়?

তারা আরও বলছেন, এটি যদি সোশ্যাল মিডিয়া হয়, তাহলে নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় কীভাবে তারা মিডিয়া পরিচয় দিয়ে কাজ করেছে? এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। এখন অনুমোদন নেই বললে প্রশ্ন আসে, প্রশাসনের লোকজন ও রাজনীতিবিদরা কীভাবে এই চ্যানেলেও সঙ্গে কাজ করলো? তারাও তো দায় এড়াতে পারেন না।

লাইসেন্সবিহীন অনলাইন চ্যানেল বা আইপিটিভি বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, 'এদের কোনো অনুমোদন নেই, এরা চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী এদের সংবাদ প্রচার করার অনুমোদন নেই। কিন্তু, তারা এই কাজটি করে। তারা একজনের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করার জন্যও চাঁদা নেয়, আবার কারো বিপক্ষে সংবাদ প্রকাশ করার হুমকি দিয়েও চাঁদা নেয়। এই কাজ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, তারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে উল্টো টাকা নেয়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সাংবাদিকদের প্রতি মাসে বেতন দেয়। আর ওইসব চ্যানেলগুলো উল্টো প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতিমাসে টাকা নেয়। এই অবৈধ কাজ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ জন্যই আমরা এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।'

২০২১ সালের ৮ নভেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয় ১৪টি ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশনকে (আইপিটিভি) শর্ত সাপেক্ষে নিবন্ধনের অনুমতি দেয়।

নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, অনুষ্ঠান তৈরি ও প্রচারের ক্ষেত্রে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য আইন, বিধিমালা, নীতিমালা, পরিপত্র, নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। বিদ্যমান কপিরাইট আইনের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। এসব আইনের কোনো ধারা যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সেন্সরশিপ কোড যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। সরকার প্রবর্তিত আইন বা বিধিবিধান অনুসরণ করে নিবন্ধনের জন্য কমিশন–নির্ধারিত নিবন্ধন ফি ও বার্ষিক নবায়ন ফি জমা দিতে হবে।

২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক নোটিশে বলা হয়, জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ (সংশোধিত ২০২০) এর ৪.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইপিটিভিগুলো কোনো রকম সংবাদ প্রচার করতে পারবে না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত আইপিটিভি এই নীতিমালা লঙ্ঘন করে সংবাদ প্রচার করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ (সংশোধিত ২০২০) লঙ্ঘনকারী আইপিটিডিগুলোকে সংবাদ প্রচার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট আইপিটিভির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago