ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর এ বছর আমের উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
 ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

একটা সময় ছিল যখন মানুষ মূলত নিজের জন্য বসতবাড়িতে বাগান বা ফলের চাষ করতো। তবে সময়ের পরিবর্তনে কৃষকরা এখন ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকছেন।

গত ২ দশক ধরে বাণিজ্যিক চাষের সাফল্যের কারণে দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে বলা যায়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১০টি শীর্ষ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল (ট্রপিকাল ফ্রুট) উৎপাদনকারী দেশের একটি। এ ছাড়া গত ১৮ বছর ধরে ফল উৎপাদনে গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

দেশে ফল চাষের জন্য সীমিত পরিমাণ জমি থাকা সত্ত্বেও এ খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। ফলে ২০০৬ সালের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ ৫৫ গ্রাম থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে এসে ৮৫ গ্রামে দাঁড়িয়েছে এবং এ সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৭ কোটিতে পৌঁছেছে।

২০১৩-১৪ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে দেশীয় ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন উল্লেখযোগ্য আকারে বেড়েছে। বিশেষ করে এ সময়ে আম, পেঁপে, পেয়ারা, কলা ও তরমুজের উৎপাদনের বৃদ্ধি অসামান্য।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর এ বছর আমের উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এফএওর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বার্ষিক কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।

এ ছাড়া জাম, লিচু, বড়ই, কামরাঙ্গা, কদবেল, লেবু, আনারস, লটকন, আতা ও সফেদার মতো ফলগুলোও বড় আকারে চাষ করা হচ্ছে।

এমনকি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের চাষও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফল উৎপাদনে একটি নীরব বিপ্লব ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো নতুন নতুন এলাকা বাণিজ্যিক ফল উৎপাদনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা এখন ফল রপ্তানিও করছি। স্ট্রবেরি, রামবুটান ও ড্রাগন ফ্রুটের মতো বিদেশি ফলও সম্ভাবনাময়।'

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে মানুষ যেমন তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে, সেই সঙ্গে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। এ কারণে সার্বিকভাবে ফলের চাহিদা বেড়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে আরও বেশি কৃষক ফল উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাত্তার মন্ডল বলেন, 'যেহেতু প্রধান খাদ্য হিসেবে ধান ততটা লাভজনক নয়, তাই বিপুল সংখ্যক কৃষক ফল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষকরা ফল চাষের জন্য প্রতিটি সম্ভাব্য জায়গা ব্যবহার করছেন।'

তিনি জানান, বাংলাদেশের মাটি মাল্টা, স্ট্রবেরি ও ড্রাগন ফ্রুটের মতো বিদেশি ফল চাষের জন্যেও অনুকূল।

এমনকি এক দশক আগেও বেশিরভাগ স্থানীয় ফল গ্রীষ্মকালের শুষ্ক আবহাওয়ায় মাত্র ৩ মাস পাওয়া যেত। মানুষ অধীর আগ্রহে সারা বছর অপেক্ষা করত মে, জুন ও জুলাই মাসের জন্য—যে সময় আম, লিচু, কাঁঠাল ও অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন ফল বাজারে আসবে।

কিন্তু দৃশ্যপট এখন পাল্টে গেছে। বিভিন্ন ফল এখন সারা বছরই পাওয়া যায়।

'বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন' প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, 'এখন আর আগের মতো অবস্থা নেই যে কিছু ফল শুধু ৩ মাস পাওয়া যাবে। আমরা এখন বছরজুড়ে পেয়ারা, কলা, পেঁপে ও আরও কিছু ফল পেতে পারি। এ ছাড়াও, আম মৌসুমের আগে ও পরে ফলন হয়, এরকম জাতের প্রচলনের কারণে আমরা সারা বছরই এই জনপ্রিয় ফল সহজলভ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছি।'

ড. মাসুদ ডেইলি স্টারকে জানান, এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে বছরজুড়ে ফলের সরবরাহ নিশ্চিত করা ও দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানো।

তিনি আরও জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১৪-১৫ সাল থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে।

'তবে এখনো আদর্শ মানদণ্ড অনুযায়ী দৈনিক ২৫০ গ্রাম ফল খাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে', যোগ করেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এই প্রকল্প শুরুর পর থেকে ১ লাখ ৭৭ হাজারেরও বেশি কৃষককে ফল চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া এ সময়ে সারাদেশে ৪৭ লাখেরও বেশি ফল গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ফলের আবাদ হয়েছিল এবং ফলন হয়েছিল ৮৭ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন।

২০২১-২২ অর্থবছরে ফল চাষের জন্য ব্যবহৃত কৃষিজমির পরিমাণ ৭ লাখ ৩৪ হাজার হেক্টর এবং ফলের উৎপাদন ১ কোটি ৪৩ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

'আবহাওয়ার ধরনে রূপান্তর আসায় আমরা এখন আরও দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল দেখছি। এই পরিবর্তন বছরজুড়ে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল চাষের জন্য সহায়ক হতে পারে', যোগ করেন সাবেক উপাচার্য সাত্তার মণ্ডল।

কৃষিমন্ত্রী আরও জানান, ফল সংরক্ষণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ জন্য সরকার 'পার্টনার' নামে একটি প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা চালুর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া কীভাবে আরও বেশিদিন ফল সংরক্ষণ করা যায়, তা খুঁজে বের করতে আমরা বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করছি।'

ড. মাসুদ জানান, ইতোমধ্যে তারা কাঁঠাল, আম ও আনারস শুকিয়ে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন, যাতে সেগুলো পরেও খাওয়া যায়।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এক দশক আগে বাংলাদেশে উৎপাদিত ফলের সংখ্যা ছিল ৫৬টি, যা এখন বেড়ে ৭২টিতে দাঁড়িয়েছে।

 

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

19h ago