‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন জরুরি’
সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইন ও নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে 'টুয়ার্ডস ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন: অ্যা রিভিউ অব ল'স অ্যান্ড পলিটিকস ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে।
গতকাল রোববার ঢাকার আগারগাঁওয়ে পর্যটন করপোরেশনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে বক্তারা বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ বা জাতি, জন্মস্থান, নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে আইন ও নীতির সামঞ্জস্যতা মূল্যায়ন করেন।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আইনের সম সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে যে সব বৈসাদৃশ্যতা আছে, তা চিহ্নিত করে সরকারি সেবায়, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, আইনগত সহায়তা ইত্যাদিতে তাদের অভিগম্যতা ও অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
তারা বলেন, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও অসম সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন: দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, প্রতিবন্ধী, হিজড়া ও ট্রাসজেন্ডার জনগোষ্ঠী আরও প্রান্তিকতার দিকে চলে যায়।
যেসব আইন ও নীতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক, তা বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এই গবেষণা প্রতিবেদনটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
তিনি বলেন, 'অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থা ও প্রতিনিধিত্ব অনেক পরিমাণে বেশি। আমি সাধুবাদ জানাই গবেষকদের যে, তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে এত গভীর একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সব প্রান্তিক অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সরকার খুবই সচেতন। এই গবেষণা সরকারের লক্ষ্য পূরণে আরও সহায়ক হবে। তাদের সুপারিশগুলো সরকার বিবেচনায় রাখবে।'
বিশেষ অতিথি মাউরিজিও চিয়ান তার বক্তব্যে বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের সরকারকে স্বাগত জানাই সব নতুন যুগোপযোগী আইন ও নীতি সংস্কারের জন্য। বৈষম্য বিরোধের সব প্রচেষ্টাকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সমর্থন করে।'
গবেষণার সুপারিশগুলো তুলে ধরে গবেষণাপত্রের সহ-সম্পাদক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, 'দলিত, হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন নিয়ে যে কথা উঠে এসেছে, তার অতি সত্তর সমাধান দরকার। তাদের পাসপোর্ট, চিকিৎসার মতো জরুরি সেবা পেতে যেন একটুও বিঘ্ন না ঘটে। এসব জায়গায় আইন সংস্করণ করে এই সকল অসামঞ্জস্য শব্দের ব্যবহার কমিয়ে তাদের সুব্যবস্থা পাকাপক্তো করতে হবে। একইসঙ্গে দেশের নাগরিকদের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। তবেই বৈষম্য বন্ধ করা সম্ভব হবে।'
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, 'বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই চাকরিতে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান না। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।'
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক সাইমী ওয়াদুদ, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) সিনিয়র সহকারী জজ রুবায়েত ফেরদৌস।
গবেষণাপত্রের সহ-সম্পাদক, ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, 'সংবিধানের প্রস্তাবনায় মৌলিক মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল ১৯৭২ সালেই। অর্থাৎ সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি সমতার অধিকারের পরিধি বোঝা প্রয়োজন। এ কারণে সমতা ও বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে শুধু সংবিধান নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও ব্যাখ্যা ব্যবহার করতে পারি।'
তিনি বলেন, 'প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, সরকারি অংশীজন—তাদের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা প্রয়োজন। রাষ্ট্র মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য। কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য অবশ্যই নিন্দনীয় এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে প্রান্তিক ও দরিদ্র ব্যক্তি, এমনকি কিশোর-কিশোরীদেরও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।'
সমাপনী বক্তব্যে নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, 'এই অসাধারণ গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে আইনকে আরও শক্তিশালী করতে পারব বলে আশা করি।'
গবেষণা প্রতিবেদনটির মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন ড. সিনথিয়া ফরিদ ও আহমেদ ইব্রাহীম। ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের ইন্টেরিম কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জেবিন।
Comments