‘গায়েবি মামলার উদ্দেশ্য বিরোধী নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করা, তাদের ভীত সন্ত্রস্ত রাখা’

‘গায়েবি মামলা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে করা হয়। কখনো এটি মিথ্যা মামলা, কখনো এটি অতিরঞ্জিত করে করা হয়। অধিকাংশ মামলা হয় একেবারেই বানিয়ে।’

'গায়েবি মামলা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে করা হয়। কখনো এটি মিথ্যা মামলা, কখনো এটি অতিরঞ্জিত করে করা হয়। অধিকাংশ মামলা হয় একেবারেই বানিয়ে।'

আজ রোববার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত 'গায়েবি মামলা ও আগামী নির্বাচন' শীর্ষক ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এ কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।

সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আইন কর্মকর্তা ড. রিদওয়ানুল হক, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা এবং সমাপনী বক্তব্য রাখেন ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিক্ষক জাহেদ উর রহমান।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, 'অনেক সময় পুলিশ বলে, বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রেখেছি আমরা। এটা যতটা না হামলা করে এর থেকে অনেক বেশি গায়েবি মামলা করে। রাজনৈতিক এসব মামলার প্রধান কাজ হচ্ছে ভুয়া নির্বাচন সাধন করা। এতে সরকার অবাধে কারচুপি করতে পারে। এ জন্য নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলা দেওয়া হয়। এই মামলা অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব।'

পুলিশ বা তাদের সোর্স সাধারণত এসব মামলা করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, সরকারি দলীয় নেতাকর্মীরাও এগুলো করছে। এই মামলা শুধুমাত্র বিরোধীদলের বিপক্ষেই করা হয়। মামলার আসামি হয় বিপুল সংখ্যক। এর মূল উদ্দেশ্য বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করা এবং তাদের ভীত সন্ত্রস্ত রাখা। এই ধরনের মামলা সরকারি দলের কারো বিরুদ্ধে হয়েছে, এমন নজির মেলেনি।'

তিনি বলেন, 'এই মামলাগুলোতে দুটো কারণে অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়। প্রথমত, বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা যেন শঙ্কায় থাকে যে, আমার নাম না থাকলেও এখানে আমাকে যুক্ত করা যাবে। আর দ্বিতীয়ত, পুলিশ যদি কাউকে গ্রেপ্তার করে এবং তার বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা নাও থাকে, তাকে অজ্ঞাতনামা আসামি থাকা কোনো একটা মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।'

হাইকোর্টের বরাত দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালে শুধু সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২০ দিনে ৩ হাজার ৭৩৬টি মামলা করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং এতে আসামি করা হয় ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে। এই আসামিদের মধ্যে মৃত, প্রবাসী, এমনকি গ্রেপ্তার হওয়া মানুষও ছিল।

আসিফ নজরুল বলেন, 'আদালত মন্তব্য করে, এই ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে রিট আমলে নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে পুলিশের আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। এসব গায়েবি মামলায় কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানাতে রুল দেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অপর বিচারপতি রিটটি আইন বহির্ভূত আখ্যা দিয়ে খারিজ করেন।'

জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাতে তিনি বলেন, 'গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৫০টি মামলা হয় শুধু ঢাকা মহানগরে। এর ৪৫টি মামলা করা হয় গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে, যখন বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ হচ্ছিল। এসব মামলা যারা করেছেন, তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা।'

'প্রত্যেকটা মামলায় ককটেল বিস্ফোরণের কথা বলা হয়। এর মধ্যে ১৭টা মামলার মধ্যে দেখা যায় ১৫টা মামলায় আওয়ামী লীগের ওপর কোনো হামলাই হয়নি। ককটেল বিস্ফোরণের কথাও শোনেনি এলাকাবাসী। আর দুটি মামলার ঘটনায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এলাকাবাসী বলছেন, এটা কে করেছে তারা জানেই না। সূত্রাপুর থানায় এক মামলার বাদী বলছেন, তিনি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছোড়ার অভিযোগ করলে পুলিশ আলামত হিসেবে ককটেল উদ্ধার করে। সেখানে বাদী জানায়, ককটেল বিস্ফোরণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি', যোগ করেন তিনি।

আরও বেশ কয়েকটি মামলার উদাহরণ টেনে আসিফ নজরুল বলেন, 'প্রত্যেক মামলায় ককটেল ঢুকানো হয়, কারণ বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় এবং এটি জামিন অযোগ্য। দুই ধারার মামলা করা হয়। এগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ ও ২০ বছরের কারাদণ্ড। আবার বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই কারণে এসব মামলার আসামিরা ভীত থাকেন।'

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন গায়েবি মামলাকে গায়েবি জানাজার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, 'একজন মানুষকে যদি দেশ ছাড়া করে দেন, ঘরে থাকতে না পারে, নির্বাচন তো দূরের কথা সে তো তার পরিবার-পরিজনকেই দেখতে পারবে না, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। নির্বাচনের আগে মামলা করায় বোঝা যায়, এটা আইনের অপব্যবহার।'

তিনি বলেন, 'এখন আইন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই। আইনের শাসন যদি না থাকে, তাহলে এই আইন দিয়ে আমরা কী করব?'

'দেখতে পাচ্ছি, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। জনগণকে জাগতে হবে। যেখানে আইনের অপব্যবহার হবে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে', যোগ করেন তিনি।

রিদওয়ানুল হক বলেন, 'পুলিশ স্টাডি করে গায়েবি মামলা দেয়। যারা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশগুলো আয়োজন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা দেওয়া হচ্ছে, যাতে সামনে তারা এ কাজ না করতে পারেন। গায়েবি মামলা থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে আগামী নির্বাচনের ফল সুখকর হবে না। এর নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।'

সাংবাদিক গোলাম মর্তুজা বলেন, 'ঘটনা কল্পিত, এ রকম মামলা আমরা প্রথম গণহারে দেখি ২০১৮ সালের আগস্টে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়। ওই সময় কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয় প্রথমে সিলেট অঞ্চলে। তখন গায়েবি মামলা নিয়ে প্রথম রিপোর্ট হয়।'

তিনি বলেন, 'ওই সময় গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে শিক্ষার্থীদের নামে প্রচুর মামলা দেওয়া হয়। ঢাকায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়। এই যে ট্রেন্ড চালু হলো, তা পরে চলতে থাকল নির্বাচন পর্যন্ত।'

সমাপনী বক্তব্যে জাহেদ উর রহমান বলেন, 'বর্তমান সরকারের আমলে যে গায়েবি মামলা করা হয়েছে, তা চরিত্রগত দিক থেকে একেবারেই আলাদা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনকে তাদের মতো ম্যানিপুলেট করা।'

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

17h ago