ঠাকুরগাঁও

নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হচ্ছে জুট করপোরেশনের জমি

পাটক্রয় কেন্দ্র
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শিবগঞ্জে জুট ট্রেডিং করপোরেশনের (জেটিসি) পাট ক্রয়কেন্দ্রের জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ছবি: স্টার

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শিবগঞ্জে জুট ট্রেডিং করপোরেশনের (জেটিসি) অধীনে 'পাট ক্রয় কেন্দ্রের' ৫৪ শতক জমি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

বর্তমানে ওই জমির আনুমানিক বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকা হলেও, তা ৩১ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় হস্তান্তরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিষয়টি জানাজানির পরও জমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। 

বাংলাদেশ জুট করপোরেশনের স্থানীয় পরিদর্শকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত জুট ট্রেডিং করপোরেশন ১৯৭৪ সালের ২৯ জুন ৪৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যে ঠাকুরগাঁওয়ের শিবগঞ্জে ৫৪ শতক জমি কেনে। পরে ওই জমি 'পাট ক্রয় কেন্দ্র' হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সারাদেশে জেটিসির অধীনে পরিচালিত সব পাট ক্রয়কেন্দ্র ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ জুট করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০০ সালের দিকে ক্রয় কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়।

এক পর্যায়ে দেশের পাটশিল্পে মন্দা দেখা দিলে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় থাকে। এর মধ্যেই পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কেন্দ্রগুলো বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শিবগঞ্জে টেন্ডার শেষে মন্ত্রণালয় ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর ৩১ দশমিক ৭৬ লাখ টাকা মূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজিউল ইসলামের কাছে ওই ৫৪ শতক সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বিষয়ে ইচ্ছাপত্র ইস্যু করে। 

শিবগঞ্জের ওই জমি বিক্রি সংক্রান্ত টেন্ডার, ইচ্ছাপত্র ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্রের কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

এতে দেখা যায়, বিক্রির শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে চুক্তির পুরো অর্থ ৩ কিস্তিতে ইচ্ছাপত্র ইস্যুর তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

কিন্তু রাজিউল মোট অংকের ২৫ ভাগ অর্থাৎ ৮ লাখ টাকা ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা আর পরিশোধ করেননি। এতে টেন্ডারের শর্ত স্পষ্টভাবে ভঙ্গ হয়েছে।

এদিকে তিনি একটি কিস্তি পরিশোধের প্রায় ৪ মাস পর ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল পাট কেন্দ্রের ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়।

দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের ২৬ জুলাই ইচ্ছাপত্রে উল্লেখিত অর্থের অবশিষ্ট ৭৫ ভাগ টাকা পরিশোধের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন রাজিউর।

বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঠাকুরগাঁওয়ের পাট ক্রয়কেন্দ্রটি ২০১১ সালের জুলাই মাসে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়।'

'পরে ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেটে প্রকাশিত হয় এবং আরও পরে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত হয়,' বলেন তিনি।

এরপর আপিল করা হলে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর তা খারিজ করেন আদালত এবং ওই সম্পত্তির মালিকানা পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুনর্বহাল থাকে।

চলতি সপ্তাহে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, 'এই অবমুক্তির চিঠি গত সপ্তাহে পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।'

যোগাযোগ করা হলে রাজিউল ইসলাম অবশিষ্ট টাকা পরিশোধের জন্য আবেদনের তথ্য স্বীকার করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অর্পিত সম্পত্তির মামলার কারণে আগে অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করা হয়নি।'

টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী টাকা পরিশোধের যে সময়সীমা ছিল, তার পরেই ওই জমিকে অর্পিত সম্পত্তি দেখিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। কেন তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করেননি—এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি রাজিউল ইসলাম।

এদিকে পাট চাষে পুনরায় গতি ফিরে আসা এবং দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় জেলায় বেশ কয়েকটি পাটকল বেসরকারিভাবে পরিচালিত হয়ে লাভজনক অবস্থানে আসায় এ অঞ্চলের চাষি ও পাট ব্যবসায়ীরা পাট ক্রয়কেন্দ্রের জমিটি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তরের বিরোধিতা করছেন। 

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মাদারগঞ্জ এলাকার চাষি রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাট ক্রয়কেন্দ্রটি চালু থাকলে পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাবে। কারণ তখন ব্যবসায়ীরা চাইলেই যোগসাজশ করে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।'

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল কাসেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সরকারি এই মূল্যবান সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তর না করে, পুনরায় কেন্দ্রটি চালু করে পাট ক্রয়ের উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন পাট চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাবেন, অন্যদিকে এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যও গতিশীল হবে।'

ওই এলাকার অপর ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, 'একদিকে যখন ব্যক্তি মালিকানায় পাটকল লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা দিচ্ছে, সে সময় সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এত দামি জমি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দুঃখজনক।'

যদি বিক্রি করতেই হয়, তবে আবার টেন্ডার আহ্বান করে চলতি বাজার মূল্যে ওই জমি বিক্রি করলে সরকারের কোষাগারে কয়েকগুণ বেশি টাকা জমা হবে বলে মনে করেন তারা।

ঠাকুরগাঁওয়ের পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা অসীম কুমার মালাকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাহিদা ও ভালো বাজার মূল্যের কারণে এই এলাকায় পাট চাষে কৃষকরা আবার আগ্রহী হয়ে উঠছেন। জেলায় গত কয়েক বছর ধরে গড়ে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে পাট চাষ হচ্ছে।'

'পাট ক্রয়কেন্দ্রটি চালু হলে ভালো বাজার মূল্যে সময়মতো পাট বিক্রির নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে, যা পাট চাষ প্রসারে সহায়ক হবে,' যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago