বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল: বাধা হতে পারে সংকীর্ণ মহাসড়ক

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। পূর্তকাজ শেষ আর এখন টানেলের বৈদ্যুতিক এবং যান্ত্রিক কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। 

পদ্মা সেতুর পর দ্বিতীয় এই ড্রিম প্রজেক্টের টোল হার এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৮ অক্টোবর টানেলটি খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

এদিকে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কারণে টানেলকে ঘিরে বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাওয়ার আশংকা পরিবহন বিশেষজ্ঞদের।

চট্টগ্রামের সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টানেলটি খোলার পর সম্ভাব্য যানজট নিরসনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্ত করার জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দ্রতগতিতে। তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন জোড়াতালি দিয়ে করা এই কাজ যাত্রীদের ভোগান্তি উল্টো বাড়াবে।

সওজ সূত্র মতে, ১৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক মাত্র ১৮ ফুট প্রশস্ত। যখন কাজ শেষে উদ্বোধনের জন্য টানেল প্রায় প্রস্তুত তখন এই মহাসড়ক ৩৬ ফুটে প্রশস্ত করার কাজ শুরু করেছে সওজ।

সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, একবার টানেল খুলে দেওয়া হলে বিদ্যমান মহাসড়কটি ভারী যানবাহন চলাচলের চাপ নিতে পারবে না। ফলে বড় আকারে যানজট দেখা দেবে, পথে ভোগান্তি হবে যাত্রীদের। তারা বলছেন, এতে করে টানেলের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না।

খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রামকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। চীনের সাংহাইয়ের আদলে "ওয়ান সিটি টু টাউন" মডেল অনুসরণ করে নির্মিত এই টানেলটি বন্দর নগরীর সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে যুক্ত করবে। যা দেশের অর্থনীতিকে আরও বেশি শক্তিশালী ও বেগবান করতে অবদান রাখবে।

সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে। এতে কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তে প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বারান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সাথে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। ফলে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং পূর্বপ্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল সহজে চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন করা যাবে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সাথে যোগাযোগ সহজ হওয়ার ফলে ওই এলাকায় পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। 

সার্বিকভাবে কর্ণফুলী টানেলের কারণে সহজ ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্পকারখানার বিকাশ এবং পর্যটনের উন্নয়নের কারণে বেকারত্ব দূর হওয়াসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। 

পরিবহন ও সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা যাত্রাপথ সহজ এবং সংক্ষিপ্ত করতে টানেল ও মহাসড়ক ব্যবহার করবেন। ভবিষ্যতে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দর, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে টানেল ও সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল বাড়বে।

নকশা অনুযায়ী কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের দিকে যে যানবাহনগুলো যাবে সেগুলো আউটার রিং রোড ব্যবহার করে পতেঙ্গা হয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। টানেল পেরিয়ে এসব যানবাহন প্রথমে সংযোগ সড়ক দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী-চৌমুহনী সড়কে উঠবে। এরপর সেগুলো পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়ক হয়ে কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ওয়াই জংশনে যাবে এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ঢুকবে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি এখনও দুই লেনের, যা ভারী যান চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

একই সাথে শাহআমানত নতুন ব্রিজ দিয়ে শহর ও উপজেলামুখী যানচলাচল করবে ফলে সার্বিকভাবে এই মহাসড়কের উপর গাড়ির চাপ বাড়বে।

তবে সওজ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন কক্সবাজার এবং মিরসরাইয়ের মেগা প্রকল্পগুলি সম্পূর্ণরূপে চালু না হলে ২০২৬ সালের আগ পর্যন্ত এসব রুটে যানবাহনের চাপ বাড়বে না।

পটিয়া ও আনোয়ারার স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, মহাসড়কের 'ওয়াই জংশন পয়েন্টে' এরই মধ্যে একটি গোল চত্বর নির্মাণ করা হয়েছে। এই চত্বরেই দুই লেনের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি ছয় লেনের পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালি (পিএবি) সড়কের সাথে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া আরেকটি রাস্তা শাহ আমানত ব্রিজ হয়ে শহরের দিকে চলে গেছে।

সরু মহাসড়কের কারণে কক্সবাজারগামী যাত্রী ও পর্যটকরা বিভিন্ন স্থানেই প্রতিনিয়তই যানজটের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া মহাসড়কে যানজটের জন্য স্থানীয় যানবাহন (সিএনজি, টমটম, নসিমন) ও স্থানীয় বাজারগুলোও দায়ী বলে জানিয়েছে পুলিশ ও স্থানীয়রা। সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও এলোমেলো পার্কিংয়ের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।

সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে প্রতিদিন ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। সংকীর্ণ রাস্তার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ও যানজট হয়।

টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে সেতু বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয় টানেল দিয়ে প্রতিদিন ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি চলবে, ২০২৫ সাল নাগাদ যা গড়ে ২৮ হাজারে পৌঁছাবে আর ২০৩০ এ প্রতিদিন টানেল দিয়ে গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬ টি গাড়ি চলবে।

টানেল উদ্বোধনের পর সড়কে বড় ধরনের যানজটের আশঙ্কা করছেন হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও। পটিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্নেহাংশ বিকাশ সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংকীর্ণ হওয়ায় প্রতিদিনই পটিয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করতে হয় পুলিশকে।'

'তিন চাকার গাড়ি, সিএনজি, বাস, ট্রাক এবং ভারী যানবাহন একসাথে চলাচল করায় এই সড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। টানেল উদ্বোধনের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে,' যোগ করেন তিনি।

সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনের করা হবে। তাদের অভ্যন্তরীণ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চার লেনের সড়কটি ২০৪০ সাল পর্যন্ত যান চলাচলের জন্য যথেষ্ট। এরই মধ্যে ১৪৮ কিলোমিটার অংশের ১৬ কিলোমিটার সড়ক (কক্সবাজার অংশ থেকে ৮ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে ৮ কিলোমিটার) চার লেন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে সওজ চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসই) মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টানেলটি খুলে দিলে মহাসড়কে ব্যাপক যানজট হবে এটা ঠিক নয়। আমরা পটিয়া থেকে সাতকানিয়ার কেরানিরহাট পর্যন্ত মহাসড়কটিকে ৩৬ ফুট প্রসারিত করছি যা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট।'

আরও আগেই কেন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেল না, এমন প্রশ্নের জবারে তিনি বলেন, 'টানেলের সময় ইনভেস্টমেন্ট যোগাড় করা একটা বিষয় ছিল। এছাড়া সেই সময় আমাদের কিছু স্টাডি চলমান ছিল। তবে আমরা অতি দ্রুতই সব করে ফেলব। বিষয়টি এমন নয় যে টানেল খুলে দিলেই মাতারবাড়ি, মহেশখালী বা মিরসরাই ইকোনোমিক জোন চালু হচ্ছে। সব মেগা প্রজেক্ট চালু হতে এখনো অনেক সময় বাকি।'

'এ ছাড়া এখন চন্দনাইশ উপজেলার কালারপোল ও পিএবি সড়কের সাথে সংযোগ সড়কের একটি প্রকল্প চলছে। সেটি হলে কক্সবাজারগামী যাত্রীরা ১০ কিলোমিটার যাত্রা পথ কমাতে পারবেন। এই রাস্তার মাধ্যমে টানেলে থেকে ছোট যানবাহনগুলো সহজেই কক্সবাজারে যেতে পারবে,' বলেন সওজ-এর কর্মকর্তা।

সওজের চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগ গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশ্লিস্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। রাস্তা করতে এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

যা বলছেন পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা

সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা টানেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন তারা কাজ শুরু করার আগে ভবিষ্যত চিন্তা করেননি। সঠিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সড়ক ব্যবস্থাপনা না থাকলে প্রচুর যানজট হবে যাতে পুরো টানেলের সুফলই বাধাগ্রস্ত হবে।'

'আপনি রাস্তা বড় করলেন কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য হাইওয়েতে কোনো সার্ভিস লেন না থাকলে ৩৬ ফুটের রাস্তা কিছুই নয়। কারণ স্থানীয় থ্রি-হুইলার, রিকশা, ইজিবাইক ও অন্যান্য পরিবহন একই সড়ক ব্যবহার করবে। সার্ভিস লেন না থাকলে সব চেষ্টাই বৃথা যাবে,' বলেন তিনি।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং পরিবহন প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর্ণফুলী টানেলের প্রবেশপথের মতো যদি মহাসড়কের রাস্তা একই মানের না হয় তাহলে যাত্রা পথের প্রোডাক্টিভিটি নষ্ট হবে।'

'২০১৮ সালে আমরা এই রাস্তায় একটি সমীক্ষা করেছিলাম এবং সওজকে পরামর্শ দিয়েছিলাম হাইওয়েতে এক্সপ্রেসওয়ের জন্য সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। আমাদের ভূমি সম্পদ সীমিত, জনসংখ্যা বেশি এবং বন্যাপ্রবণ এলাকার দিকটি বিবেচনা করে আমরা একটি পিলার ব্যবহার করে এর উপরে চার লেন বা দুই লেনের একটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলাম। হ্যাঁ এটি ব্যয়বহুল কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য এটি অনেক বেশি টেকসই,' তিনি বলেন।

তিনি যোগ করেন, 'টানেল করা হয়েছে ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে কিন্তু অ্যাপ্রোচ রোড দেখে আমার তা মনে হয় না। পতেঙ্গা এবং আনোয়ারার অবস্থা একই রকম। আমাদের বুঝতে হবে প্রথমে টুইন সিটির ধারণা কী এবং সর্বশেষ কনফিগারেশন কী।'

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

13h ago