আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস

‘মা, আমি কি দেখতে বাবার মতো হয়েছি?’

গুমের শিকার সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানা ছেলের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না। তিনি কেবল কেঁদেই চলেন।
২০১৩ সালে ঢাকার বংশালের ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমান যখন গুম হন, সাফা তখন তার মায়ের গর্ভে। বুধবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাবার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সাফা। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

১০ বছর আগে ঢাকার সূত্রাপুরের ছাত্রদল নেতা খালিদ হাসান সোহেল যখন গুম হন, তখন তার ছেলের তাকে চেনার বয়স হয়নি। তাই বাবাকে নিয়ে ছেলের কোনো স্মৃতিও নেই।

এখন খানিকটা বড় হয়ে সবকিছুতেই বাবার সঙ্গে মিল খুঁজে বেড়ায় ওই শিশু। মায়ের কাছে নানা প্রশ্ন করে বাবার সঙ্গে তার মিল-অমিলের বিষয়গুলো খুঁজে নিয়ে অনুভব করতে চায় না থাকা বাবার অস্তিত্ব।

মাকে সে জিজ্ঞেস করে, 'আমি কি দেখতে বাবার মতো হয়েছি? আমি কি এখন বাবার সমান হয়ে গেছি। আমার হাতগুলো কি দেখতে বাবার মতো?'

সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানা ছেলের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না। তিনি কেবল কেঁদেই চলেন।

আজ বুধবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় মাইক্রোফোনের সামনে এই কথাগুলো যখন বলছিলেন শাম্মী সুলতানা, তখনো তিনি কাঁদছিলেন। কান্নার দমকে কথা জড়িয়ে আসছিল তার। সেই কান্না সংক্রমিত হচ্ছিল উপস্থিত সবার মধ্যেও।

শাম্মী বলেন, 'আমি ওকে কি জবাব দেবো। ছোট থাকতে ওকে বলতাম যে বাবা বাইরে গেছে, আসবে। এখন তো ও বড় হয়েছে। এখন ওকে আমি কি বলে সান্ত্বনা দেবো?'

শাম্মীর মতো গুমের শিকার এবং পুলিশের নির্যাতনে নিহত ও গুরুতর আহত ৬০টির বেশি পরিবারের সদস্যরা আজ সকালে কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে উপস্থিত হয়েছিলেন, যারা প্রিয়জনের খোঁজ পেতে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছেন। একে একে তাদের অনেকের বক্তব্যেও বোঝা গেল, সান্ত্বনার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তারাও। কিন্তু দুঃসহ অপেক্ষার যে যন্ত্রণা ক্রমেই তা আরও ভারী হয়ে চেপে বসছে তাদের প্রত্যেকের ওপর।

সভায় অংশ নিয়ে বরাবরের মতোই তারা গুম হওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানান। সভাটি আয়োজন করে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন 'মায়ের ডাক'।

নিদারুণ অপেক্ষা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

'মনে হয় আমরাই অপরাধী'

ইমনের বাবা ছিলেন লক্ষ্মীপুর থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। ছিলেন ২ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে র‌্যাব ও ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো ইমনরা জানেন না, তার বাবা বেঁচে আছেন না মরে গেছেন।

সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে ইমন বলেন, 'আমরা কী অপরাধ করেছিলাম? আমাদের বাবার কী দোষ ছিল? তিনি তো একজন জনপ্রতিনিধিও ছিলেন। তিনি তো কোনো ক্রিমিনাল ছিলেন না। আমরা সমাজের যেখানেই বলি যে আমাদের বাবা গুম হয়েছেন সবাই আতঙ্কিত হয়ে যায়। যখন কোনো অফিস-আদালতে যাই সবাই ভয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। মনে হয় আমরাই যেন অপরাধী।'

'আজকের নীরবতা কাল আপনার সন্তানের কান্না হবে'

সায়েদুল ইসলাম রিমনের বাবা মফিজুল ইসলাম রাশেদ ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল ডিবি পরিচয়ে রাশেদকে তুলে নেওয়া হয়। ১০ বছরেও তার খোঁজ মেলেনি।

রিমন বলেন, 'বাবার খোঁজ পেতে আমার মা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এরপর থেকে ছোট ভাইকে নিয়ে কী রকম মানবেতর জীবনযাপন করছি, তা বলে বোঝানো সম্ভব না।'

রিমন আরও বলেন, 'অনেক বলেছি এই সরকারকে। তারা আমাদের কথা শোনে না। শুনলেও আমলে নেয় না। তারা এটা আমলে নেবেও না। কারণ যে অপরাধ তারা নিজেরা করেছে তার বিচার তারা কীভাবে করবে। নিজের গলায় তো নিজে ফাঁসি পরাতে পারবে না তারা।'

'তারা অনেকভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করে আসছে। আমার মায়ের লাশ নেওয়ার জন্য আমি যখন পুলিশ স্টেশনে যাই আমাকে তারা একপ্রকার বাধ্য করে বলতে যে আমার বাবা মৃত। এটা লিখে আমি আমার মায়ের লাশ নিয়ে আসছি। এমন পরিস্থিতি দেশে এই সরকার সৃষ্টি করেছে।'

এ অবস্থায় গুমসহ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রিমন বলেন, 'আপনারা আর চুপ থাকবেন না। আপনার আজকের নীরবতা কালকে আপনার সন্তানের কান্না হবে।'

বাবার খোঁজে ৭ বছর। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

'যখন ক্লাস ওয়ানে উঠব তখন কি বাবা আসবে'

২০১৬ সালের ৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরমানকে মিরপুর ডিওএইচএসের বাসা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।

আরমানের স্ত্রী তাহমিনা বলেন, 'ওর খোঁজে গেলে আমাকে বলা হতো, "কোনো কথা বলা যাবে না। চুপ থাকতে হবে।" আমি চুপ থেকেছি ৭ বছর। কিন্তু কোনো প্রতিকার আমি পাইনি।'

সে দিনের কথা স্মরণ করে তাহমিনা আরও বলেন, 'বারবার ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকলে তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ওকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। তাকে স্যান্ডেলটা পর্যন্ত পরতে দেয়নি। আমার ছোট মেয়েগুলো স্যান্ডেল হাতে করে গেট পর্যন্ত গিয়েছে। তাতেও ওদের মন গলেনি।'

আরমানের বড় মেয়ে এখন পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ছোট মেয়ে পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাহমিনা বলেন, 'প্রত্যেকটা ক্লাসে যখন ওরা প্রোমোটেড হয় বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করে, "মা যখন ক্লাস ওয়ানে উঠব তখন কি বাবা আসবে। বাবা কোথায়? আসে না কেন।"'

গুমের শিকার যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে, যারা নিখোঁজ তাদের অবস্থান আমাদের জানাতে হবে।

— নূর খান লিটন, মানবাধিকার কর্মী

'বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার অধিকার হরণ করছে এই সরকার'

সভায় উপস্থিত প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আখতার বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন পঁচাত্তরে তার বাবা-মা-ভাই-বোনদের নিহত হওয়ার কথা বলেন, এখনো দেখি তার গলাটা ভারি হয়ে যায়। তিনি বিচার করেছেন তাদের (হত্যাকারীদের)। কিন্তু তিনি কী জবাব দেবেন এই মায়েদের? তিনিও তো মা।'

ফরিদা আখতার আরও বলেন, 'তার (শেখ হাসিনা) ১৪ বছরের শাসনামলে ১২ বছর ধরে মায়ের ডাক রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছে। বাচ্চারা অপেক্ষা করছে। অনেক বাবা সন্তানের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মারা গেছেন।

'এখন যে প্রশ্নটা তোলো দরকার তা হলো, বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার অধিকার হরণ করছে এই সরকার। তারা খেলতে পারত। ভালোভাবে বাঁচতে পারত। আনন্দে থাকতে পারত। তাদের জীবন এখন কান্নায় ভরে গেছে।'

'গুম করা হয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য'

সভায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, 'এখানে অনেক মা প্রশ্ন করেছেন কেন তাদের সন্তানরা গুম হলেন, শিশুরা প্রশ্ন করেছে কেন তাদের বাবারা গুম হয়েছে। এদের গুম করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য। ভুয়া নির্বাচন করার জন্য। গণতন্ত্রের জন্য যারা সংগ্রাম করে, বাংলাদেশকে যারা ভালোভাবে তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করার জন্য। ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করার জন্য।'

তিনি আরও বলেন, 'যদি গুমের বিচার চাই আমরা, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, বাংলাদেশে বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।'

'বিরোধী দল ও মতকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই এ ঘটনা'

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনের পর্যবেক্ষণ হলো, নির্বাচনের আগে কিংবা বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় গুমের ঘটনা বেশি ঘটে।

তার ভাষ্য, 'পারিপার্শ্বিকতা প্রমাণ করে যে বিরোধী দল ও মতকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়। এটা কখনোই ঘটতে পারে না যদি সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। বা যদি সরকার এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না থাকে তাহলে প্রতিনিয়ত এ ঘটনা ঘটতে পারে না।'

প্রধানমন্ত্রী এ দায় এড়াতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন নূর খান লিটন।

নির্বাচনের আগের সময়টি খুব আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে লিটন আরও বলেন, 'প্রায়ই আমরা লক্ষ্য করছি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন এই খবরটা পাচ্ছি। এর সঙ্গে নতুন করে সরকারি মদদে বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করে এই গুমের ব্যাপারে একটা খণ্ড-বিভ্রিান্তকর তথ্য প্রচারের চেষ্টাও হতে পারে।'

যারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে নূর খান লিটন বলেন, 'গুমের শিকার যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে, যারা নিখোঁজ তাদের অবস্থান আমাদের জানাতে হবে।'

সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, অধ্যাপক সি আর আবরার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান, ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, মায়ের ডাক-এর সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি।

সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম।

সভা শেষে অংশগ্রহণকারীরা পদযাত্রা করে কাকরাইল মোড় থেকে নয়াপল্টন পর্যন্ত যান।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ব্যাপারে জার্মান দূতাবাসের উদ্বেগ

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়েছে জার্মান দূতাবাস।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আতঙ্ক ছড়ানোর কৌশল হিসেবে গুমকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এটি পৃথিবীর কোনো সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকায় জার্মান দূতাবাস গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

ওই পোস্টের সঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত একটি কোলাজ যুক্ত করা হয়েছে। কোলাজে ৭০ জন বাংলাদেশি নাগরিকের ছবি আছে।

Comments