খুলনায় দুস্থদের কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রি করল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন

‘তবে বিদ্যানন্দকে নয়, সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হবে অন্য কোনো অভাবীকে।’
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন আয়োজিন ‘বাকির হাট’। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

'বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না'—লেখাটি অনেক দোকানেই দেখা যায়। যাতে ক্রেতারা বাকিতে পণ্য না কেনেন, তাই দোকানিরা এটি লিখে রাখেন। নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে যারা বাসার আশেপাশের দোকান থেকে বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনী পণ্য কিনে থাকেন, লেখাটি তাদের জন্য একটু বিব্রতকর তো বটেই! কিন্তু টানাপোড়েনের এই জীবনে মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে বাকিতে পণ্য না কেনার সুযোগ মধ্যম বা নিম্ন আয়ের মানুষ আর পাচ্ছে কই!

দোকানিরাও সাধারণত বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে খুব একটা ইচ্ছুক নন। তবে এর বিপরীত উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। গরিব ও দুস্থদের কাছে বাকিতে পণ্য দিতে তারা আয়োজন করেছিল 'বাকির হাট'র।

গতকাল বুধবার খুলনায় সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আয়োজিত এই কর্মসূচির মাধ্যমে দুই শতাধিক পরিবার বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগ পান। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, লবণ, শাকসবজি, মাছ, মুরগি, শিশুদের শিক্ষা উপকরণ, কাপড়সহ প্রায় ২৫ ধরনের পণ্য নিয়ে বসেছিল এই 'বাকির হাট'।

শহরের সাত নম্বর ঘাট এলাকা থেকে 'বাকির হাটে' এসেছিলেন মরিয়ম বেগম। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এই ৭০ বছর বয়সে কখনো শুনিনি বা দেখিনি যে কেউ ডেকে এনে বাকিতে জিনিসপত্র বিক্রি করছে। কতজনকে তো দেখি আমাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে। আশপাশের দোকানগুলোতে গেলে বাকিতে তো দেয়ই না, উপরন্তু টাকা দিয়ে কিনতে গেলেও অবহেলা করে। বাকিতে পণ্য বিক্রি করে, এই রকমের মানুষও দেশে আছে!'

খুলনা প্রেসক্লাবের লিয়াকত আলী মিলনায়তনে বসা 'বাকির হাটে' সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মরিয়মের মতো আরও অনেকেই গতকাল এসেছিলেন এই হাটে। তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই ছিল বেশি।

নগরীর গল্লামারি থেকে আসা বিজন সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেউ সেধে বাকিতে জিনিস দেয়, জীবনে এই প্রথম দেখলাম। আসলে তারা আমাদের কষ্ট বুঝে। তাই বিভিন্নভাবে আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।'

বিষয়টি নিয়ে বিদ্যানন্দের পক্ষ থেকে জানানো হয়, 'বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না' এই স্লোগানের পরিবর্তে 'বাকি চাইতে লজ্জা পাবেন না' স্লোগানটির প্রমোট করছেন তারা হতদরিদ্র মানুষের জন্য।

সংগঠনটির ভাষ্য, এই পরিবারগুলোর কাছে আজকে টাকা নেই। কিন্তু একদিন তাদেরও টাকা হবে। সেদিন তারা এই টাকা পরিশোধ করবে। তবে বিদ্যানন্দকে নয়, সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হবে অন্য কোনো অভাবীকে।  এমন শর্ত দিয়েই ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকার পণ্য দেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি। বাজার শেষে প্রতিটি ক্রেতার নাম ও বাকির পরিমাণ লিখে একটি আঙ্গুলের ছাপ নিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা, যা দিয়ে প্রতীকীভাবে এই বাকির কথা খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে।

কেউ যাতে অতিরিক্ত পণ্য না নেন, সেজন্য স্বেচ্ছাসেবীদের তদারকি করতে দেখা গেছে।

'সমাজের মানুষ যেন একে অপরকে সাহায্য করে'—'বাকির হাট'র মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টাই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন৷ একইসঙ্গে সাহায্য চাওয়া কোনো লজ্জার বিষয় না, বরং সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্য করা মানবিক একটি দায়িত্ব—সেই দায়িত্বের কথাই তারা এই উদ্যোগের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. হাসিব মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারা ওই হাট থেকে পণ্য কিনবেন, তা নির্ধারণে শহরের বিভিন্ন এলাকায় এক সপ্তাহ ধরে জরিপ করা হয়েছে এবং অভাবী পরিবার চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট কার্ড প্রদান করা হয়েছে। সেই কার্ড দেখিয়ে পরিবারগুলো "বাকির হাট" থেকে কেনাকাটার সুযোগ পেয়েছেন।'

অভিনব আইডিয়ার মাধ্যমে মানবসেবামূলক কাজের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বিশেষ করে করোনাভাইরাসকালে জীবনবাজি রেখে সম্মুখে থেকে কাজ করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। সমাজসেবায় তাদের অসামান্য অবদানের জন্য ২০২৩ সালে সরকার তাদের একুশে পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়াও, ২০২২ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের জাতীয় মানবকল্যাণ পদক ও ২০২১ সালে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেওয়া 'কমনওয়েলথ পয়েন্টস অব লাইট' পদকে ভূষিত হয় এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

Comments