নতুন ধানের নবান্নে ‍উৎসবের বর্ষপঞ্জি শুরু

বৃহস্পতিবার অগ্রহায়ণের প্রথম দিবস। কার্তিকের পোয়াতি ধান পেকে উঠতে শুরু করেছে এর আগেই। কাঁচা সবুজ ধানের দানায় দানায় জমে থাকা সাদা ‍দুধ এখন শুভ্র চালে রূপ পেয়েছে। কুয়াশাভেজা মাঠ থেকে সবুজ থেকে সোনালি হয়ে ওঠা সেই পাকা ধান কেটে আনার তোড়জোড় চলছে গ্রামে গ্রামে। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে এই ধান মাড়াই-মলন শেষে নতুন চালের ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েসে জনপদ থেকে জনপদে হবে নবান্ন।
নবান্ন
বিচিত্র আর বাহারি নামের রকমরি সব ধানে সমৃদ্ধ এই দেশে কার্তিকের খাদ্যাভাব বাঙালিকে যতটা বিচলিত করত, অগ্রহায়ণের শস্যপ্রাপ্তি তাকে ঠিক ততটাই আনন্দ দিত। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এটি কোনো ধর্মীয় আচার, ব্রত কিংবা পূজা নয়; বরং রিচুয়াল বা লোকাচার বলা যেতে পারে। অঞ্চল কিংবা ধর্মভেদে এই লোকাচার পালনের আচার ভিন্ন। আবার তা পালনের সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অথবা তিথি-নক্ষত্রের যোগ নেই। তবে শস্যপ্রাপ্তির সংযোগ আছে।

একসময় শস্যকেন্দ্রিক নানা রীতিনীতি প্রচলিত ছিল বাঙালি সমাজে। কারণ ধানই ছিল এদেশে সমৃদ্ধির শেষ কথা। আকাশমণি, কপিলভোগ, কাজলা, কামিনী, কুসুমকলি, ঘৃতশাল, চন্দনচূড়া, চন্দ্রপুলি, চিনিসাগর, জটাশালী, জনকরাজ, জামাইভোগ, দাদখানি, দুধকমল, নীলকমল, পঙ্খিরাজ, পদ্মরাগ, হীরাশাল, মানিকশোভা, মুক্তাঝুরি- এমন বিচিত্র আর বাহারি নামের রকমরি সব ধানে সমৃদ্ধ এই দেশে কার্তিক মাসের খাদ্যাভাব বাঙালিকে যতটা বিচলিত করত, অগ্রহায়ণের শস্যপ্রাপ্তি তাকে ঠিক ততটাই আনন্দ দিত। আহারে-বিহারে সেই আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার উৎসবই নবান্ন; দেশের প্রাচীনতম লোকউৎসবগুলোর একটি।

নবান্ন
আমন ধান পাকলেই নবান্ন করেন প্রান্তিক কৃষক। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বৃহস্পতিবার অগ্রহায়ণের প্রথম দিবস। কার্তিকের পোয়াতি ধান পেকে উঠতে শুরু করেছে এর আগেই। কাঁচা সবুজ ধানের দানায় দানায় জমে থাকা সাদা ‍দুধ এখন শুভ্র চালে রূপ পেয়েছে। কুয়াশাভেজা মাঠ থেকে সবুজ থেকে সোনালি হয়ে ওঠা সেই পাকা ধান কেটে আনার তোড়জোড় চলছে গ্রামে গ্রামে। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে এই ধান মাড়াই-মলন শেষে নতুন চালের ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েসে জনপদ থেকে জনপদে হবে নবান্ন।

নবান্নের শব্দগত অর্থ 'নতুন অন্ন', অর্থাৎ নতুন খাবার। গ্রামবাংলার উৎসবের বর্ষপঞ্জির শুরুটা হয় এই নবান্ন দিয়েই। আর সমাপ্তি ঘটে চৈত্রসংক্রান্তির চড়কে। নবান্নকে মূলত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং আগামী বছরের জন্য সুফসল প্রাপ্তির কামনায় নিবেদিত উৎসব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন লোক সংস্কৃতি গবেষকরা।

নবান্ন
নতুন ধানের শরীরে শিশিরের উৎসব। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

একসময় বাংলা মাসই শুরু হতো অগ্রহায়ণ (অগ্র+আয়ন) দিয়ে। কথিত আছে, মোগল শাসনের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে বন্যায় আমন ধান নষ্ট হয়ে গেলে খাজনা আনাদায়ী থাকত। তাই খাজনা আদায় নিশ্চিত করতে পয়লা অগ্রহায়ণের বদলে পয়লা বৈশাখ থেকে খাজনা আদায় করার আইন করা হয়। এ ব্যাপারে প্রয়াত লেখক, লোক সংস্কৃতি ও পল্লীসাহিত্য গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান তার এক লেখায় বলছেন, 'মোগল সম্রাটেরা সুবেদার মুর্শিদ কুলি খানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে প্রচুর পরিমাণে কর আদায়ের নির্দেশ জারি করেন। কৃষিভিত্তিক বাংলায় মোগলদের আচরিত 'হিজরি সন' কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য ছিল প্রতিকূল। কারণ, প্রতিবছর হিজরি সন সাড়ে ১০ বা ১১ দিন পিছিয়ে যায়। এদিক বিবেচনায় রেখে মুর্শিদ কুলি খান আকবর-প্রবর্তিত 'এলাহি সন'র আদলে বাংলায় হিজরি চান্দ্র ও ভারতীয় সূর্য-সনের সম্মিলনে বাংলা সন চালু করেন বলে মনে হয়।'

এই পরম্পরাতেই সম্ভবত পয়লা অগ্রহায়ণের বদলে এখন বাঙালির প্রধান উৎসব নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ। তাই সর্বপরিসরে অগ্রহায়ণের নবান্নের সেই জাঁকালো ভাব আর নেই। তবু গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রীতিতে পালিত এই শস্যোৎসব ইতিহাসের সেই ধারাকে অনেকখানি ধরে রেখেছে।

নবান্ন
গৃহস্থ বাড়ির উঠানে ধানের মাড়াই-মলন শেষে নতুন চালের ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েসে হবে নবান্ন জনপদ থেকে জনপদে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

লোকসংস্কার অনুযায়ী, হেমন্তের নতুন আমন ধান ঘরে এনে প্রথমে তা গৃহদেবতাকে নিবেদন করা হয়। যেহেতু দেবতার বরে ফসল ফলে, সে জন্য দেবতাকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস সব কৃষকই করে থাকেন। সামাজিক প্রথা, রীতি ও কৃত্যের পরিক্রমায় জায়গায় জায়গায় মাঘ মাসেও নবান্ন উদ্‌যাপনের প্রথা রয়েছে।

এ কথা জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উদয় শংকর বিশ্বাস বলছেন, নাটোরের বাগাতিপাড়ার জামগ্রামের শাঁখারীরা নবান্নের দিন কোনো কাজ করেন না। এ দিন বাড়ির নারীরা নয় রকম ফল দিয়ে নয়টি কলাপাতায় নৈবেদ্য সাজিয়ে বাড়ির তুলসীতলা, রান্নাঘরের দরজায়, গোয়ালঘরের দরজা, উঠান ও ঠাকুর ঘরসহ নয় জায়গায় তা রেখে দেন। নয় রকম সবজি দিয়ে নয় ধরনের ব্যঞ্জন তৈরি করা হয় দুপুরে খাবারের জন্য। খাবারের তালিকায় থাকে নয় রকম শাক। খান নয় ধরনের মিষ্টান্ন। আসলে তাদের কাছে নবান্ন নয়ের প্রতীক।

আবার বগুড়ার নন্দীগ্রামের হিন্দু নারীরা নবান্নের দিন দিনের বেলায় কোনো আগুনের কাজ করেন না। নবান্নের দিন সূর্য ওঠার আগে কৃষক মাঠে গিয়ে ধানের জমিতে ফুল-তুলসী-চালকলা-ফল দিয়ে নৈবেদ্য প্রদান করেন। বাড়িতে জমির ধানের গোছা কেটে নিয়ে এসে ঘরের দরজায় টাঙিয়ে দেন। এরপর বাড়ির সবার জন্য মাছ কিনতে যান। নবান্নের দিন বগুড়ার নন্দীগ্রাম-শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মাছের মেলা বসে।

নবান্ন
বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ আসে পিঠা-পুলি-পায়েসের অন্যতম উপকরণ খেজুরের রস নিয়েও। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বরিশালের উজিরপুর-আগৈলঝাড়া উপজেলার হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজন নবান্নে নতুন ধানের চালের গুঁড়িতে বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে এক ধরনের শরবত তৈরি করেন। সকালে প্রতিটি বাড়িতে নারায়ণপূজা করা হয়।

নওগাঁর মান্দা-আত্রাই অঞ্চলে নবান্নের দিন সারা বাড়ি পরিষ্কার করে নতুন ধানের চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি পিটুলির সাহায্যে বাড়ির উঠান ও ঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকা হয়। সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর পূজা করেন বাড়ির নারীরা।

এভাবে পুরো অগ্রহায়ণজুড়ে লক্ষ্মীর পূজা করা হয় অন্তত চারবার। আর বেশির ভাগ অঞ্চলে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় নতুন ফসলের পায়েস, ভাত, নানা ব্যঞ্জন প্রথমে কাক বা পাখিদের নিবেদন করার রীতি দেখা যায়। বিশ্বাস, এতে মৃত পূর্বপুরুষরা খুশি হন এবং পাখিদের মাধ্যমে সেই খাদ্য তাদের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়।

বাঙালি হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও নতুন চালের পায়েস রেঁধে মসজিদে শিরনি দেন। এ ছাড়া নবান্নের দিন লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান।

উদয় শংকরের ভাষ্য, 'বাঙালির প্রধানতম উৎসবটি বিক্ষিপ্তভাবে পালন করা হলেও এখন আর ঘটা করে সাড়ম্বরে নবান্ন পালনের রীতি খুব বেশি চোখে পড়ে না। সনাতন হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো এই লোকাচারটি পালন করা হয় পুরোনো রীতি মেনে, কিন্তু বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজে নবান্ন এখন অনেকটাই ব্রাত্য। এরও বহুবিধ কারণ রয়েছে।'

নবান্ন
ফুলের বুকে শিশিরের নৈবেদ্য অগ্রহায়ণকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

তবে শহুরে জীবনেও বেশ কয়েক বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব পালন করা হচ্ছে। জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

গত ১০ নভেম্বর ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কাউটিয়া গ্রামে হয়ে গেল 'কৃষকের নবান্ন উৎসব'। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পাঁচ শতাধিক মানুষ এই উৎসবে যোগ দেন। উৎসবের আয়োজন করে প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র। ঢেঁকি ছাটা নতুন চালের গুঁড়ি, ডাবের পানি, নারিকেল, কলা ও গুড় দিয়ে তৈরি নবান্ন আহার, মুঠো পিঠা, সেমাই পিঠা ও পায়েসসহ নানা ধরনের মুখরোচক এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার ছিল এ আয়োজনে। ছিল বিলুপ্তপ্রায় দেশি ধানের প্রদর্শনী।

পয়লা অগ্রহায়ণের নবান্ন কেন পঁচিশে কার্তিকে করা হলো- তার ব্যাখ্যায় উৎসবের আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আমন ধান পাকলেই নবান্ন করেন প্রান্তিক কৃষক। কার্তিকের শেষ ও অগ্রহায়ণের শুরুতে ধান পাকলে নতুন ধানের চালের পায়েস, ক্ষীর ও চালের গুঁড়ার পিঠা পুলি খাওয়া সেলিব্রেট করাই নবান্ন তাদের কাছে। আর আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর বাংলাদেশে ধান আগে পেকেছে। তাই পঞ্জিকার পয়লা অগ্রহায়ণের আগেই জীবনানন্দের কার্তিকের নবান্ন হচ্ছে।'

তাই, এই কথা বলাই যায় যে, 'প্রচুর শস্যের গন্ধ' এবং 'পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে' নবান্নকে কেবল পঞ্জিকার পাতায় আটকে রাখা যাচ্ছে না।

Comments

The Daily Star  | English

Army given magistracy power

In order to improve law and order, the government last night gave the power of magistracy to commissioned army officers for 60 days.

15m ago