খাসিয়াদের বর্ষবরণ

‘বাংলাদেশে আমরা ২০১১ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি।’
খাসিয়াদের উৎসব উদযাপন। ছবি: স্টার

মাঠের এক পাশে তৈলাক্ত বাঁশের খুঁটির ঠিক ওপরে একটি মোবাইল ফোন রাখা। নিচ থেকে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছেন অনেকে। অনেক চেষ্টার পর একজন বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠে মোবাইল ফোনটি জিতে নেন। আরেক পাশে তীর ধনুক নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে তীর ছোড়েন কয়েকজন তরুণ। কেউ বা আবার গুলতি দিয়ে সামনে রাখা লক্ষ্যে ছুড়ে মারছে।

নারীরা ব্যস্ত পান গোছানোর প্রতিযোগিতায়। মাঠের মাঝখানে রাখা পানগুলো কে, কত কম সময়ে গোছাতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তারা।

বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মাঠে গিয়ে এমন প্রতিযোগিতা দেখা যায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী 'খাসি' জনগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান 'সেং কুটস্নেম' উপলক্ষে এই আয়োজন করে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল। আয়োজনে সহযোগিতা করে মনিপুরী ললিতকলা একাডেমী ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।

বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে প্রতিযোগিতাগুলো ছিল বেশ আকর্ষণীয়। অনুষ্ঠানে আসা সবাই আনন্দে মেতে ছিলেন খাসি জনগোষ্ঠীর নানান আয়োজনে।

বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১২৪তম বর্ষকে বিদায় ও ১২৫তম বর্ষকে বরণ করে নিয়েছে খাসিয়া জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ২৩ নভেম্বর খাসি বর্ষবিদায় 'খাসি সেং কুটস্নেম' পালন করা হয়। আজ শুক্রবার থেকে শুরু হবে খাসি বর্ষবরণ।

খাসিয়াদের উৎসব উদযাপন। ছবি: স্টার

দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন খাসিয়া পুঞ্জি থেকে আসা খাসি জনগোষ্ঠী ও অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। এই দিনটি খাসিয়া সম্প্রদায়ের জন্য খুবই আনন্দের। অনুষ্ঠান দেখতে বাইরে থেকেও আসেন অনেক অতিথি ও পর্যটক।

খাসি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেং কুটস্নেম বা বর্ষবিদায় খাসিয়াদের একটি সার্বজনীন উৎসব। প্রতি বছরের মতো এবারও কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া পুঞ্জির খেলার মাঠে নানা সমাহারে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই দিন বর্ষবিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানান তারা।

দুপুরে মাগুরছড়া ফুটবল মাঠের একপ্রান্তে বাঁশের খুঁটির ওপর প্রাকৃতিক পরিবেশে বেত গাছের পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি করা মঞ্চে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়।

খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী (সমাজপ্রধান) জিডিসন প্রধান সুছিয়াংর সভাপতিত্বে ও খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সম্পাদক ফিলা পতমীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন, কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সঞ্জয় চক্রবর্তী, 'বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরাম'র সভাপতি পিডিশন প্রধান সুছিয়াং বাংলাদেশ মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ মনিপুরী ললিতকলা একাডেমীর গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাষ কুমার সিংহসহ আরও অনেকে।

বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে খাসিয়ারা তাদের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে আদি পাহাড়ি নৃত্য ও গান করেন শিল্পীরা। পাশাপাশি তাদের জীবিকার প্রধান উৎসব জুম চাষের এবং জীবন-জীবিকার বিভিন্ন পদ্ধতি নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন।

এদিকে উৎসব উপলক্ষে সকাল থেকে মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠে বসে ঐতিহ্যগত মেলা। মেলায় খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসেন বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পান, তীর, ধনুকসহ বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়। খাসিয়া সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা অংশগ্রহণ করেন।

খাসিয়াদের উৎসব উদযাপন। ছবি: স্টার

এই উৎসবে আসা সোমা দাশ বলেন, 'এই উৎসবে আমি এবার প্রথম এসেছি। এখানে এসে খাসিয়াদের অনেক কিছু দেখতে পেলাম। অনেক ভালো লেগেছে।'

খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ও উৎসব আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক ফিলা পতমী বলেন, 'খাসি সেং কুটস্নেম বাংলায় করলে হবে খাসি বর্ষবিদায়। ১৮৯৯ সাল থেকে খাসি জনগোষ্ঠীর লোকজন এই অনুষ্ঠান করলেও বাংলাদেশে আমরা ২০১১ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি।'

'দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হরতাল অবরোধের কারণে এ বছর আমাদের আয়োজন কিছুটা সীমিত করা হয়েছে। তবুও আমরা চেষ্টা করছি এই উৎসবটি পালন করার,' বলেন তিনি।

Comments