ডিজিটাল প্রতারণা: ‘বেতন পাবেন প্রতিদিন ১১১৫ টাকা’

‘এ প্রতারণায় অনেকে ১০ লাখ, ২০ লাখ বা ৩০ লাখ টাকাও হারিয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে এখন চাকরির খোঁজ করছেন রনি (ছদ্মনাম)। হঠাৎ একদিন ফোনে একটি এসএমএস পান ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ। ইংরেজিতে লেখা ওই এসএমএসে বলা হয়েছে, 'বেতন পাবেন প্রতিদিন ১১১৫ টাকা। অনলাইনে আমাদের কোম্পানির জন্য কাজ করুন। বিস্তারিত জানতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করুন।'

ওই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করা হলে অপর পাশ থেকে টেক্সট পাঠিয়ে বলা হয়, 'চ্যাট রেকর্ড রাখার জন্য আমাদের কোম্পানি ভয়েস কল বা ফোন কলে কথা বলার অনুমতি দেয় না। তাই টেক্সটেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।'

আরেকটি টেক্সটে বলা হয়, 'আমি জেমিনি কোম্পানির হায়ারিং ম্যানেজার বলছি। আমাদের কোম্পানি বড় বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ইউটিউব ও ফেসবুক ভিডিওতে লাইক, সাবস্ক্রিপশন বাড়ানোর কাজ করে।' শ্যানেল, ডিওর, মার্সিডিস বেঞ্চের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আপনাকে শুধু তাদের পোস্ট লাইক বা কমেন্ট করতে হবে। একেকটি টাস্কের জন্য আপনি দুই থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাবেন।'

তাকে তিনটি ভিডিও লিংক পাঠানো হয় এবং বলা হয়, ওই ভিডিওগুলোতে লাইক দিয়ে স্ক্রিনশট পাঠালে তাকে প্রতি ভিডিওর জন্য ৫০ টাকা করে ১৫০ টাকা দেওয়া হবে। 'আমার কাছে পুরো বিষয়টি বেশ রহস্যময় লাগে। যে তিনটি ভিডিও আমাকে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলো ছিল নামকরা ঘড়ির ব্র্যান্ড রোলেক্সের। পরে আমি তাদের মেসেজে আর সাড়া দিইনি,' বলেন রনি।

ডিজিটাল প্রতারণা: ‘বেতন পাবেন প্রতিদিন ১১১৫ টাকা’
মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপে নানা ধরনের বার্তা পাঠায় এসব চক্র।

পুলিশ বলছে, এই ধরনের চক্রের সদস্যরা সাধারণত প্রথমে অল্প পরিমাণ অর্থ (১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত) দিয়ে মানুষের মনে বিশ্বাস স্থাপন করে। পরে বড় অঙ্ক পাঠালে সুদসহ আরও বেশি টাকা ফেরত দেবে, এমন প্রলোভন দেখিয়ে তারা মূলত ওই অর্থটা হাতিয়ে নেয়।

বিভিন্ন বয়সী অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিদিনই মোবাইলে ও হোয়াটসঅ্যাপে এই ধরনের বিভিন্ন মেসেজ পান তারা। চারজন জানিয়েছেন, শুধু মেসেজ না, তাদেরকে ফোন করেও এই ধরনের 'ফ্রিল্যান্সিং' কাজের অফার দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সবুজ বলেন, 'আমি একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পেয়েছিলাম। ওপাশ থেকে আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলা হচ্ছিল। নারীকণ্ঠের একজন আমাকে বলেন, তিনি একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এইচআর বিভাগে কাজ করেন। আমাকে তারা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিয়োগ দিতে চান।'

'তার কথা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম যে উনি বাংলাদেশি কেউ, কারণ তার ইংরেজি উচ্চারণ বিদেশিদের মতো না। আমি বুঝতে পারি এটা স্ক্যাম। আমি ফোন কেটে দিই।'

একই কথা জানান ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাঈফ (ছদ্মনাম)।

'আমাকে একটি বাংলাদেশি নম্বর থেকে ফোন করা হয়। বলা হয়, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম জিনিয়াস আইটি টেকনোলজি, অফিস মহাখালীতে। তারা প্রথমে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ইউটিউব চ্যানেলের লিংক পাঠাবে। ওই চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে আমি যদি স্ক্রিনশট পাঠাই, তাহলে আমাকে বিকাশ অথবা নগদ নম্বরে ৩০০ টাকা পাঠানো হবে,' বলেন তিনি।

এরকমই একটি অফারে সাড়া দিয়ে ৯ লাখ টাকা হারিয়েছেন ফয়সাল আহমেদ (ছদ্মনাম)। তাকে 'অ্যাডভান্স টাস্কস ৪৪৪' নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করা হয়। সেখানে বিভিন্ন টাস্ক শেষ করে তিনি ৭ হাজার ৮৯৫ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। তারপর ফয়সালকে বলা হয়, 'সি-ফাইন্যান্স' নামে একটি সাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তাকে নয় হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে বলা হয়। এর কয়েকদিন পর আবারও তাকে ৩৬ হাজার টাকা দিতে বলা হয়। এভাবে অতিরিক্ত সুদসহ ফেরত দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার কাছ থেকে ৯ লাখ হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।

একইরকমভাবে পাঁচ হাজার টাকা হারিয়েছেন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা মো. কামরুল (ছদ্মনাম)। অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমাকে শুরুতে দুটি ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে বলা হয়। সাবস্ক্রাইব করে তাদেরকে স্ক্রিনশট পাঠানোর পর তারা আমার ফোনে ৩০০ টাকা পাঠায়। এটা ছিল টাস্ক ১। এরকম আরও অনেকগুলো টাস্ক আসতে থাকে। তারা জানায়, পরে ধীরে ধীরে টাকা বাড়ানো হবে।'

কামরুলকে বলা হয়েছিল, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের একজন ফ্রিলান্সার। তার সঙ্গে যিনি কথা বলতেন, তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।

ডিজিটাল প্রতারণা: ‘বেতন পাবেন প্রতিদিন ১১১৫ টাকা’
মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপে নানা ধরনের বার্তা পাঠায় এসব চক্র।

'আমাকে একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ করা হয়। ওই চ্যানেলে আরও ৩০ জন ছিল। সেখানে আমাদের টাস্ক দেওয়া হতো। সবাই টাস্ক শেষ করে স্ক্রিনশট পাঠাত। পরে একটা ওয়েলফেয়ার সেশন নেওয়া হত। সেখানে দুই হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা চাইত। বলা হত, মার্চেন্টের ক্রিপ্টোকারেন্সির অনুমান ঠিক প্রমাণের জন্য আমাদেরকে একটি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে হবে। নতুনদের জন্য দুই হাজার টাকা আর পুরোনোদের জন্য পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ করতে হবে। তারা একটি তালিকা দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে—দুই হাজার টাকা পাঠালে দুই হাজার ৬০০ টাকা ফেরত, পাঁচ হাজার পাঠালে সাত হাজার ফেরত, নয় হাজার পাঠালে ১২ হাজার ৬০০ ফেরত, ১৫ হাজার পাঠালে ২১ হাজার ফেরত, ৩০ হাজার পাঠালে ৪২ হাজার ফেরত পাঠানো হবে।'

গ্রুপটিতে থাকা সদস্যদের অনেকে দুই হাজার থেকে নয় হাজার টাকা পর্যন্ত ওই নম্বরে পাঠান। অনেকে আবার জানান যে তারা সুদসহ টাকা ফেরত পেয়েছেন।

শুধু ফয়সাল কিংবা কামরুল নন। অন্তত ১০০ জন বাংলাদেশি এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

গত ১১ নভেম্বর প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেন ফয়সাল। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সাইবার ও বিশেষ অপরাধ বিভাগ এ মামলার তদন্ত করে।

ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ জানান, আগে থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে এমন সিম থেকেই টেক্সট পাঠায় এই প্রতারক চক্র।

গত দুই মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত এক ডজনেরও বেশি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে।

এর মধ্যে গত ২৫ নভেম্বর একজন চীনা নাগরিক সহ ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি এই ধরনের প্রতারণায় জড়িত আরও ৮ জন এবং ১৪ জানুয়ারিতে আরও একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, 'এখানে যেটা ঘটছে সেটি সবচেয়ে পুরোনো অপরাধগুলোর একটা, এটা হলো প্রতারণা। আগেও বিভিন্ন রকমের প্রতারণার ঘটনা ছিল, এখনো আছে। যে মানুষগুলো এর শিকার হয়েছেন, তারা মূলত লোভে পড়েই এই ফাঁদে পা দিয়েছেন। আপনাকে তো বুঝতে হবে যে এত সহজে আয় করা সম্ভব না। এত সহজে যে আপনাকে টাকা দেবে বলছে সে তো অবশ্যই সৎ নয়, সে কাজও সৎ নয়।'

'আমাদের যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আছেন, তাদের উচিত এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া। এই দায় তারা এড়াতে পারেন না। পুলিশ কর্মকর্তা বা তাদের আত্মীয় স্বজনরাও নিশ্চয়ই এই ধরনের মেসেজ পেয়েছেন। তাদের পরিচিত লোকজনও নিশ্চয়ই এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন,' ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সহকারী কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ধরনের মেসেজ ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে আসে। অনেক সময় বিদেশি নম্বর থেকে আসে। আমরা এখন পর্যন্ত তদন্তে জেনেছি যে, মূলত চীন ও নাইজেরিয়ার কয়েকটি স্ক্যামার চক্র এর সঙ্গে জড়িত। কোনো ক্ষেত্রে হয়তো ভারতীয় কিছু নাগরিকও জড়িত। তারাই বাংলাদেশি লোকজনকে ব্যবহার করে এটা করে। এটা একটা সংঘবদ্ধ চক্র। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে টাকাটা বিদেশে নেয়। এর একটি বড় মাধ্যম হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি।'

'এ প্রতারণায় অনেকে ১০ লাখ, ২০ লাখ বা ৩০ লাখ টাকাও হারিয়েছে। এমন অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। সম্প্রতি আমরা এমন একটি চক্রও ধরেছি। তারা ছয় মাসে ৫০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছে। চক্রটি দুই বছর ধরে এই কাজ করছিল, অর্থাৎ তারা প্রায় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন করে থাকতে পারে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'চক্রগুলো সাধারণত প্রথমে অল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে মানুষের মনে বিশ্বাস স্থাপন করে। পরে বড় অঙ্ক পাঠালে তারা সুদসহ আরও বেশি টাকা ফেরত দেবে, এমন প্রলোভন দেখিয়ে মূলত ওই অর্থটা হাতিয়ে নেয়। এরপর তারা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারে না ভুক্তভোগীরা।'

এসব প্রতারকদের ধরতে পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'পাশাপাশি জনসচেতনতার জন্য আমরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে নিয়মিত পোস্ট করছি।'

Comments