বাংলাদেশ

গ্রামীণ ব্যাংক ছিল আমাদের স্বপ্নের বীজতলা: ড. ইউনূস

'আমরা বলেছিলাম যে চাকরির পেছনে মানুষ ঘুরবে না, চাকরি মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ হলো একজন উদ্যোক্তা।'
ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টেলিভিশন থেকে নেওয়া ছবি

'গ্রামীণ ব্যাংক ছিল আমাদের একটা স্বপ্ন। আমরা পৃথিবীকে বদলাতে চাই। দারিদ্র্যকে মুছে ফেলতে চাই। এটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা পেছনে লেগেছিলাম।'

আজ রোববার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

যারা এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্গে ছিলেন তাদেরও মামলার আসামি করায় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

এসময় সাংবাদিকদের সামনে মামলার অন্য তিন আসামিকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। তারা হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের শীর্ষ কর্মকর্তা নুরজাহান বেগম, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং আশরাফুল হাসান।

ড. ইউনূস বলেন, 'চার জন আসামির একজন আমি। আরও তিন জন আসামির কথা কেউ বলে না। একজন হলেন নূরজাহান বেগম। আমার সামনেই আছে। তাকে একটু দেখেন সবাই। এই নূরজাহান বেগম জোবরা গ্রামে এই যে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু হলো ওনার হাত দিয়ে। উনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ছিলেন, আমি শিক্ষক ছিলাম। উনি বাংলা বিভাগের। ভলান্টিয়ার হিসেবে তিনি এসেছিলেন। তার হাত দিয়ে জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা। এই যে পুরো কাহিনী শুরু হলো। উনি এবং তার স্বামী। তার স্বামী ছিলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। সেই থেকে যত ঘটনা ঘটেছে গ্রামীণ ব্যাংকে তার গোড়া থেকে উনি ছিলেন। যেমন গ্রামীণ ব্যাংকের ১৬ সিদ্ধান্ত। এটা প্রায় একটা চার্টার।  গ্রামীণ ব্যাংক বুঝতে হলে ওখানে যেতে হবে। অঙ্গীকার হচ্ছে যে পরিবর্তন করার জন্য। যৌতুক প্রথার বিরোধীতা করা- এর নেতৃত্বে সেটা হয়েছে সারা বাংলাদেশে। কিন্তু কেউ এটা স্মরণ করে না। আজকে তাকে হাজিরা দিতে হচ্ছে। দুঃখ এটা আমাদের।'

তিনি বলেন, 'গ্রামে বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া। তখনকার যে পরিস্থিতি ছিল, শিশুদের যে পরিস্থিতি ছিল, ভিটামিন 'এ' নিয়ে আসা শিশুদের জন্য, যাতে করে সে রাতকানা রোগে না ভোগে। বাংলাদেশের তখন সর্বত্র রাতকানা রোগ। এই ১৬ সিদ্ধান্তের প্রতিনিধি নির্বাচনে তিনি ছিলেন। আজকে তাকে আমরা আদালতে নিয়ে এসেছি। এবং প্রতিবারই আসছেন। এবং গতবার যখন এসেছিলেন তিনি বারবারই জিজ্ঞেস করছিলেন জেলে আমি কী নিয়ে যাব? কী কী নিতে পারব? নামাজের কাপড়টা নিতে পারব কি না? ওষুধগুলা নিতে পারব কি না? গতবার তিনি এসেছিলেন তখন ওষুধ নিয়ে এসেছিলেন। হয়তো আদালত থেকেই আমার চলে যেতে হবে। এই যে দুর্ভাগ্য আমাদের, যে সারা জীবন দিলো এসবের জন্য তাকে আদালতে যাওয়ার জন্য, জেলখানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হয়।'

এসময় মামলার অপর দুই আসামি মোহাম্মদ শাহজাহান এবং আশরাফুল হাসানকে নিয়ে কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমার সঙ্গে আছেন আরেকজন শাহজাহান সাহেব। উনিও গ্রামীণ ব্যাংকের গোড়ার থেকে আমার সঙ্গে আছেন। উনি আরেকজন আসামি। উনি হাঁটতে পারেন না। চলতে পারেন না। ছয় তলায় তাকে বহন করে ওঠাতে হয়েছে, নামাতে হয়েছে। সেই হলো আমাদের শাস্তি। আরেকজন হলো এইখানে দাঁড়িয়ে আছেন আশরাফ। এই মামলার আসামি। এই আশরাফ সে সদ্য বুয়েট থেকে পাস করেছে। তাকে আমরা নিলাম। আমাদের একজন ইঞ্জিনিয়ার লাগবে, তুমি আসো। তো সে বুঝতে পারছিল না আমরা কী করি, সে কী করবে। তখন গরীব মানুষের ঘর বাড়ি ছিল না। আপনাদের সেসব দিনের কথা হয়তো স্মরণ নাই। পাটখড়ি দিয়ে ঘর বানাতো মানুষ। পাটখড়ির চাল, আর পাটখড়ির দেয়াল। আমরা বলেছি গ্রামীণ ব্যাংকে যারা যোগ দেবে তারা পাটখড়ির ঘরে আর থাকবে না। তাদের জন্য আমরা সুন্দর একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবো। আমরা গৃহঋণ শুরু করলাম। গৃহঋণ ছিল ৫ হাজার-৭ হাজার টাকা। ম্যাক্সিমাম ছিল ১০ হাজার টাকা। এই ছিল গৃহঋণ। ক্রমে ক্রমে সে শোধ করবে। যতদিন সময় লাগবে।'

'আশরাফকে বললাম, তুমি একটা ডিজাইন করো, কীভাবে ঘরটা বানাবে। আশরাফ নতুন মানুষ, ও একটা বানালো। চারটা খুঁটির ওপরে একটা টিনের চাল। এই হলো তার চার খুঁটির টিনের চালের ঘর। আমরা গৃহঋণের দিতে থাকলাম। মানুষ উৎসাহী। আগে বলেছে আমরা গরুর ঘরে গরুর সঙ্গে থাকতাম, ছাগলের সঙ্গে থাকতাম এখন আমরা ঘর পেয়েছি, আমার এখন ঘর হয়েছে। টিনের চালের ঘর হয়েছে, খুঁটির জোরের ঘর হয়েছে। আমাদের কোনো ধারণা ছিল না যে এই চার খুঁটির টিনের চালের বাড়ি আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার পুরস্কার পাবে। ১৯৮৯ সালে এই ঘর আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড পেলো। সেই বছর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ আরেকটি আগা খান আর্কিটেকচার পুরস্কার পেয়েছিল সেটি হলো লুই কানের পার্লামেন্ট। বিশ্বের সেরা আর্কিটেক্ট। কাজেই সেই একই বছরে এদিকে লুই কান পুরস্কার পাচ্ছে এদিকে আশরাফ পুরস্কার পাচ্ছে। তাকে নিয়ে এখানে আমরা হাজিরা দিচ্ছি।'

ড. ইউনূস বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংক ছিল আমাদের একটা স্বপ্ন। যে আমরা পৃথিবীকে বদলাতে চাই। দারিদ্র্যকে মুছে ফেলতে চাই। এটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা পেছনে লেগেছিলাম। জানি না আমরা ভবিষ্যতে আমাদের কী হবে না হবে। আমাদের কোনো কিছুই জানা ছিল না। আমরা গিয়েছি, খুঁটিনাটি দেখে দেখে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ফলে গ্রামীণ ব্যাংক আস্তে আস্তে প্রসারিত হলো। এটা হয়ে গেল আমাদের অপ্রত্যাশিত একটা বীজতলা। স্বপ্নের বীজতলা। আমরা স্বপ্ন দেখি আর বীজ বুনি এটার মধ্যে। কী হবে ভবিষ্যতে। সেটা ক্রমে ক্রমে আমরা প্রসারিত করলাম, নানা দিকে গেলাম-- স্বাস্থ্যের দিকে, প্রযুক্তির দিকে নিয়ে গেলাম, একটার পর একটা। সেখানে আজকে যা কিছু করছি সবকিছুর বীজতলা ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। ২০১১ সালে আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হলো। ভাবলাম বীজতলা রয়ে গেল একদিকে। আমাদের লোকজন যারা এই স্বপ্নের পেছনে তারা রয়ে গেল। আমরা যাবো কোথায়। আস্তে আস্তে আমরা এগুলো বড় করলাম। আমাদের এই যে প্রত্যেকটা জিনিস আজকে আপনারা শুনছেন যে আমরা করছি, কী করেছি আমরা? আমরা বলেছিলাম যে চাকরির পেছনে মানুষ ঘুরবে না, চাকরি মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ হলো একজন উদ্যোক্তা। তার জন্মই হলো উদ্যোক্তা হিসেবে। এই কাঠামো ভুল। এর পেছনে আমরা লাগলাম। যে সকল মানুষ উদ্যোক্তা, শুধু ব্যাংকিং সিস্টেমের ভুল কাঠামোর কারণে মানুষ চাকরির পেছনে ছুটছে। চাকরিটা হলো দাসত্বের একটা জিনিস। তুমি একজনের জন্য জান দিয়ে তো খাটবে মাসের শেষে দিনের শেষে তোমাকে কিছু ভাগ দেবে রোজগারের। অল্প সামান্য। এটা মানুষের জন্য না। এই দাসত্ব থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাই। আমরা নমুনা দিলাম গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলাদের গ্রামের অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মহিলারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নেমে গেছে। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা সকল মানুষের নাই আমরা সেটাকে সামনে নিয়ে এলাম যে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা যেন উন্মুক্ত হতে পারে। তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসলাম উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য। সেখানে মূল অর্থনৈতিক তথ্যকে আমরা চ্যালেঞ্জ করলাম।'

Comments