দুঃখু মিয়ার আলো ছড়ানোর গল্প

জন্ম থেকেই দুই হাত নেই দুঃখু মিয়ার (৫৮)। বড় হতে হতে তার সেই দুঃখকে আরও বাড়িয়ে তোলে সমাজের লাঞ্ছনা আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব। হাত নেই বলে মাদরাসায় ভর্তি নেননি শিক্ষকরা।
ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পাঠ দিচ্ছেন দুঃখু মিয়া। ছবি: জাহিদুল ইসলাম জয়/স্টার

জন্ম থেকেই দুই হাত নেই দুঃখু মিয়ার (৫৮)। বড় হতে হতে তার সেই দুঃখকে আরও বাড়িয়ে তোলে সমাজের লাঞ্ছনা আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব। হাত নেই বলে মাদরাসায় ভর্তি নেননি শিক্ষকরা। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ডিগ্রি পাস করলেও জোটেনি কাজ।

এখন পৈতৃক জমিতে সেই দুঃখু মিয়ার গড়ে তোলা কিন্ডারগার্টেনে পাঠ নিচ্ছে ১৩০ শিশু; যেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে পাঠদানের ব্যবস্থা।

এভাবে নিজে বঞ্চিত হয়েও হাতহীন দুঃখু মিয়া সমাজের প্রতি, প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছেন সহমর্মিতার হাত।

দুঃখু মিয়ার পুরো নাম আলতাফ হোসেন দুঃখু মিয়া। ২০০৭ সালে নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদনা এলাকায় তার নিজের নামে তৈরি প্রতিভা দুঃখু মিয়া কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনিই। এ স্কুলের ১৩০ শিশুকে পড়ানোর জন্য আছেন নয় জন শিক্ষক। কাজ করছেন আরও দুই কর্মচারী। এখানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়।

এই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচদনা ইউনিয়নের দিঘিরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় তার। পরে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ১৯৮৬ সালে ডিগ্রি পাস করেন।

সম্প্রতি দুঃখু মিয়ার স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেড ভবনের একটি শ্রেণিকক্ষে পা দিয়ে বোর্ডে লিখছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন গল্পের ছলে।

দুঃখু মিয়া বলেন, 'ছোটবেলায় বাবা আমাকে স্থানীয় একটি মাদরাসায় ভর্তি করাতে নিয়ে যান। হাত না থাকায় পা দিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তে হবে—এই কারণ দেখিয়ে আমাকে ভর্তি নেননি শিক্ষকরা। ডিগ্রি পাসের পর বিভিন্ন দপ্তরে পরীক্ষা দিয়েও চাকরি হয়নি। উল্টো ভর্ৎসনার শিকার হয়েছি। মনে হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানো পাপ।'  

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তাড়না কোথা থেকে পেলেন জানতে চাইলে এই প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, 'আমি আমার এলাকার শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো বিলিয়ে যেতে চাই। আরও চাই কোনো প্রতিবন্ধী শিশু যেন শিক্ষা নিতে এসে আমার মতো হেয়-প্রতিপন্ন না হয়। এমন ইচ্ছা থেকেই এই উদ্যোগ।'

এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কারও মুখাপেক্ষী হননি দুঃখু মিয়া। নিজের পৈতৃক জমিতে নিজের টাকাতেই তা গড়ে তুলেছেন তিনি।

স্কুলটিকে একটি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরের স্বপ্নের কথা জানিয়ে এই সমাজহিতৈষী বলেন, 'আমি চাই আরও বড় পরিসরে গেলে এই স্কুলটির দায়িত্ব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই নেবেন। চাই আমার প্রতিষ্ঠানটি হবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শেষ ভরসা।'

বাবার গড়া এই স্কুলেই সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন দুঃখু মিয়ার ছেলে মোহাইমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমার বাবা সমাজে শিক্ষার প্রসারে কাজ করছেন। এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে!'

প্রধান শিক্ষকের প্রতি মুগ্ধতা ঝরল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তারের কণ্ঠেও। সুমাইয়া বলে, 'আমাদের স্যার পা দিয়ে লেখেন। কিন্তু আনেকের হাতের লেখা থেকে তা সুন্দর। স্যার খুব যত্ন করে পড়ান। ওনার জীবনসংগ্রাম আমাদের অনুপ্রাণিত করে।'

স্কুলের আরেক সহকারী শিক্ষক আসমা বেগমের কাছেও দুঃখু মিয়া এক অনুপ্রেরণার নাম। তিনি বলেন, 'স্যারের জীবন আমাদের বিরুদ্ধস্রোতে এগিয়ে চলার সাহস দেয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Opening aid corridors, leasing out ports not this govt's job: Tarique

"It seems that the interim government is prioritising providing corridors or handing over port management to foreign entities. We want to make it clear that the government elected by the people will make decisions regarding corridor or leasing out port management."

1h ago