ইউরোপে স্থায়ী হতে মরিয়া তারা

আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যথাযথ কাগজ নিয়ে ইউরোপে যাওয়া ব্যক্তি যেমন আছেন, আবার যথাযথ কাগজ ছাড়াই ইউরোপে গিয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিও আছেন।
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

'নিজ দেশে উন্নত জীবনের সুযোগের অভাবে' গত বছর রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা এজেন্সি ফর অ্যাসাইলামের (ইইউএএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডসহ (ইইউ প্লাস) ২৭টি ইউরোপিয়ান দেশে মোট ৪০ হাজার ৩৩২ বাংলাদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন।

এই আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যথাযথ কাগজ নিয়ে ইউরোপে যাওয়া ব্যক্তি যেমন আছেন, আবার যথাযথ কাগজ ছাড়াই ইউরোপে গিয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিও আছেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত '২০২৩ সালে সর্বশেষ আশ্রয়প্রবণতা' শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং ২০১৫ সালে পাওয়া ১৭ হাজার ২১৭টি আবেদনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

বিশেষজ্ঞরা ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সিআর আবরার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দমন-পীড়ন এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেছি। ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে নিরাপত্তা খুঁজতে যাওয়ার এটা অন্যতম কারণ হতে পারে।'

তিনি বলেন, 'মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চায়। আমাদের দেশে এই পরিবেশ অনুপস্থিত। সেইসঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোতে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ খুব সীমিত। এর কারণেও আশ্রয় চাওয়ার সংখ্যা বেশি হতে পারে।'

এ ছাড়া, ভাগ্যের চাকা বদলে নিতেও অনেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে আশ্রয় চাইতে পারেন বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই সাবেক শিক্ষক।

ইইউএএ'র ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ২৩ হাজার ৪৪৮ জন বাংলাদেশি ইতালি আশ্রয় নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। এটি মোট আবেদনের প্রায় ৫৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার ২১৫টি আবেদন জমা পরেছে ফ্রান্সের জন্য।

এ ছাড়া, রোমানিয়া ২ হাজার ৮২২, অস্ট্রিয়া ১ হাজার ৪০৯, গ্রিস ৬৪০, আয়ারল্যান্ড ৪৪৫, স্পেন ৩৮০, সাইপ্রাস ৩১৪, জার্মানি ১৬৪, মাল্টা ১১৮ এবং বাকি ইইউ প্লাস দেশ মোট ৩৭টি আবেদন গ্রহণ করছে।

২০২২ সালে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৭৩১ জন।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান মনে করেন, নথিভুক্ত ও অনথিভুক্ত বাংলাদেশিরা ভ্রমণ ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসায় যাওয়ার পর ইউরোপীয় দেশগুলোতে আশ্রয় চায়।

তিনি বলেন, 'সাধারণত যুদ্ধ বিধ্বস্ত এবং মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশের মানুষ এভাবে আশ্রয় চায়।'

'কিন্তু, বাংলাদেশের সেই পরিস্থিতি নেই। তবুও, বাংলাদেশিরা নিজেদের ও পরিবারের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা চায়,' যোগ করেন তিনি।

শরিফুল বলেন, 'কর্মসংস্থানের অভাবও অনেক মানুষ ওইসব দেশে পাড়ি জমাতে চান।'

গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে বেকার গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৯০ হাজার। পাঁচ বছরে যা দ্বিগুণ হয়ে ৭ লাখ ৯৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেকার রয়েছেন এমন মানুষের হার ২০১৬-১৭ সালে ছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছে যে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি যুবক গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর অন্তত এক বা দুই বছর বেকার থাকেন।

ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী সংস্থা ফ্রন্টেক্সের মতে, বিভিন্ন স্থল ও সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইউরোপে অভিবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যাও বেড়েছে।

'২০২৩-২৪ এর জন্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ' শিরোনামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানোর প্রচেষ্টাকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৫৩৫, যা ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ২ হাজার ২৫৪ জন।

শরিফুল উল্লেখ করেন, ৯০ শতাংশের বেশি আবেদন বাতিল হয়ে যায়, কারণ আবেদনকারীরা তাদের মাইগ্রেশনের জন্য বৈধ কারণ দেখাতে পারেন না।

যারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছান তাদের সম্পর্কে শরিফুল আরও বলেন, 'তারা সেখানে বৈধভাবে থাকার জন্য আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন।'

তিনি ইতালি, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আশ্রয় চাওয়াকে কেন্দ্র ব্যবসার কথা তুলে ধরেন, যেখানে ফার্মগুলো আশ্রয়প্রার্থীদের আইনি সহযোগিতা দেয়। এর ফলে প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থী যারা আছেন, তাদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক লামিয়া মোমেন বলেন, 'সারা বিশ্বেই এটা দেখা যায় যে মানুষ অবৈধ উপায়ে অন্য কোনো দেশে প্রবেশ করলে সেই দেশে বৈধভাবে থাকতে আশ্রয় চায়।'

'এটা বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ অভ্যাস,' যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, সাধারণত রাজনৈতিক নিপীড়ন, নিপীড়নের ভয়, দেশে উন্নত সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা খোঁজে।

লামিয়া মোমেন বলেন, 'এই কারণগুলোর মধ্যে একটি বা একাধিক কারণ বিশ্লেষণ করলেই সহজেই বোধগম্য হয় যে কেন রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় চাইছে।'

তিনি যোগ করেন, 'আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য ব্যাপক গবেষণা জরুরি।'

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

18h ago