২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ বাড়বে ৫৩ শতাংশ

বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এর সুদ পরিশোধ এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় সরকার ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ ৫৭ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি। এর ফলে দেশের কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর আরও চাপ বাড়বে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেওয়া বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এর সুদ পরিশোধ এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় সরকার ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩৭ হাজার ৭৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডলারের গড় দাম ছিল ১০৯ টাকা ৯৭ পয়সা।

এই বিনিময় হারে সরকার চলতি অর্থবছরে ৩ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে এবং আগামী অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজন ৫ বিলিয়ন ডলার।

তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ পরিশোধের সময় টাকা ও ডলারের বিনিময় হারের ওপর নির্ভর করবে যে মোট কত টাকা পরিশোধ করতে হবে।

বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের খরচ কয়েক বছর ধরে বেড়েছে। এই খাতে খরচের পরিমাণ প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ২০১২-১৩ অর্থবছরে।

এর নয় বছর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে এই পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের বছর বাংলাদেশ ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করে। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতে চলেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ঋণের আসল ও সুদ মিলিয়ে পরিশোধ করা হয়েছে ২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৯ শতাংশ বেশি।

গত জুলাই-মার্চ মাসে শুধুমাত্র সুদের অর্থ গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে। এই প্রথম সুদ পরিশোধে খরচের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এই পরিমাণ ছিল ৪৮৫ মিলিয়ন ডলার।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার হলে ঋণ পরিশোধে দুই বা তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করা কোনো সমস্যা হতো না। ২০২২ সালের প্রথম দিকে যেমনটা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যখন রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারেরও কম, তখন ঋণ পরিশোধের জন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা কঠিন। কারণ বিদেশি মুদ্রায় এই অর্থ প্রদান করতে হয় এবং এই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হয়।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ মে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আগামী কয়েক বছরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করা একটি প্রধান সমস্যা হবে। আমাদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আরও বেশি অর্থ আয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।'

তিনি বলেন, 'সরকারকে হুন্ডি এবং অন্যান্য মাধ্যমে অর্থপাচারের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স হতে হবে।'

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারের প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়নে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং প্রতিটি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিত করা উচিত।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে এবং বৈদেশিক ঋণ আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।

ইআরডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য দেশকে এখন ব্যয়বহুল বাজারভিত্তিক হারে ঋণ নিতে হবে।

যখন ঋণের পোর্টফোলিও বাজারভিত্তিক হারে নির্ধারিত হয়, তখন সুদের হারের ঝুঁকি বেশি হয়। কারণ, এই ঋণের অর্থ পরিশোধের পরিমাণ বিশ্ব অর্থনীতির অস্পষ্টতার ওপর নির্ভর করে।

বিশ্বব্যাপী সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণের ব্যয় বাড়ছে। বাজারভিত্তিক ঋণের সুদের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন ইআরডির এক কর্মকর্তা।

২০২৩ সালে বাজারভিত্তিক হারে প্রায় দুই দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার, যা মোট প্রতিশ্রুত ঋণের ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে এই পরিমাণ ছিল তিন দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

ওই ইআরডি কর্মকর্তা বলেন, 'মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পের জন্য তহবিল ছাড়ের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। কারণ, এসব প্রকল্পের ভৌত কাজ শেষ পর্যায়ে।'

এ ছাড়া, করোনা মহামারির প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে উত্তরণে সহায়তা করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ প্রদান ত্বরান্বিত করায় গত তিন বছরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য বাজেট সহায়তা পেয়েছে। এতে ঋণ পরিশোধের গতি বেড়েছে।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'তাছাড়া, কিছু বড় ঋণের গ্রেস পিরিয়ড আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।'

গ্রেস পিরিয়ডের সময়কালে ঋণগ্রহীতা শুধুমাত্র সুদ প্রদান করে। এই সময়কাল শেষ হওয়ার পর সুদ ও আসলসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে খরচ বেড়েছে এবং রেয়াতি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।'

'এ ছাড়া, সরকার গত কয়েক বছরে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

Comments