পদের সঙ্গে পদক ও সম্পদ বেড়েছে বেনজীরের
সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ একদিকে যখন 'অর্জন' করে যাচ্ছিলেন মর্যাদাপূর্ণ পুলিশ পুরস্কার, অপরদিকে তখন তিনি ও তার পরিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে কিনে যাচ্ছিলেন একরের পর একর জমি এবং অন্যান্য সম্পত্তি।
প্রায় ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে তিনি পাঁচবার বাহিনীর সর্বোচ্চ পদক 'বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল' (বিপিএম) লাভ করেন।
র্যাবের সাবেক এই মহাপরিচালক সেরা করদাতা পুরস্কার এবং শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেয়েছেন।
তিনি ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন।
অবসর গ্রহণের দুই বছরেরও বেশি সময় পর চলতি মাসে ঢাকার একটি আদালত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ করার আদেশ দেওয়ার পর আবারও খবরের শিরোনামে এসেছেন তিনি।
দুদকের নথিতে দেখা যায়, বেনজীর ও তার পরিবার ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ২০৪ দশমিক ৫ একর জমি কিনেছেন।
এর মধ্যে ১১২ একর কিনেছেন তিনি পুলিশ ও র্যাব প্রধান থাকাকালে।
এ পর্যন্ত তদন্তকারীরা ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কক্সবাজারে তার এবং তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের মালিকানাধীন জমির সন্ধান পেয়েছেন।
এর মধ্যে প্রায় ১১২ একর জমি তার নিজ জেলা গোপালগঞ্জে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে বাহিনীতে সাহসী ভূমিকা, জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান, রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবদানের জন্য বিপিএম পুরষ্কার পান বেনজীর।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতিবার বিপিএম পুরস্কার অর্জনে তিনি একটি পদক, এক লাখ টাকা এবং একটি সনদ পেয়েছেন। এ ছাড়া, অতিরিক্ত হিসেবে প্রতিবার পুরস্কার প্রাপ্তির পর তার মূল বেতনের সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা যোগ হয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেনজীর। এর মধ্যে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান এবং রাজনৈতিক সহিংসতা দমন, পেট্রোল বোমা হামলা দমন ও হোলি আর্টিসানে জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বেনজীরকে বিপিএম পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী বেনজীর ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ তাকে ২০২০-২১ সালে তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়। অথচ, দুদকের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ও তার পরিবার ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় ৮৭ দশমিক ৯ একর জমি কিনেছিলেন।
শুদ্ধাচার পুরস্কারে একটি সনদপত্র, একটি ক্রেস্ট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জুনে পুরস্কার পাওয়ার পর বেনজীর ঘোষণা দেন যে তিনি তার পুরস্কারের অর্থ সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের সহায়তার জন্য দান করবেন।
ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি স্ট্র্যাটেজি অনুসারে, শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর মাধ্যমে একটি সমাজের মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ বোঝানো হয়—কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও নৈতিকতার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন ও যাপিতজীবন।
২০২১ সালে বেনজীরকে সেরা করদাতা নির্বাচিত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
যে সময়ে তাকে সেরা করদাতা হিসেবে মনোনীত করা হয়, ওই সময়ে তিনি ও তার পরিবার ১৩৮ একরেরও বেশি জমির মালিক ছিলেন।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত দুদিনে বেনজীরের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, 'শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। আমরা খতিয়ে দেখব, তিনি কীভাবে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।'
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'অবাধ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনজীর আহমেদ বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। এটা ওপেন সিক্রেট ছিল। কিন্তু তিনি প্রভাবশালী হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কেউই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস করেনি। সাবেক পুলিশ প্রধান যা করেছেন তা কল্পনার বাইরে।'
তিনি বলেন, 'যখন ক্ষমতা ছিল, তখন যা খুশি তাই করতে পারতেন এবং তারপরও পার পেয়ে গেছেন। তিনি ভেবেছিলেন যে সব সময় তার একই অবস্থা থাকবে। তিনি এখন সরকারের আনুকূল্য না থাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'
'শুদ্ধাচার পুরস্কারের মতো মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা,' যোগ করেন তিনি।
সুজন সম্পাদক বলেন, 'আমি তো ভেবে অবাক হই, র্যাব ও পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালনের সময় বেনজীর আহমেদ যখন দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিলেন, তখন কর্তৃপক্ষ কী গভীর ঘুমে ছিল!'
Comments