মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুই হয় ঘুষ দিয়ে

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উভয় সরকারের কাছে এ বিষয়ে তদন্ত, অপরাধীদের বিচার এবং নৈতিক নিয়োগের নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন।

জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞের পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুই হয় দেশটির মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে। এই ঘুষ দিতে হয় 'ভুয়া নিয়োগকর্তাদের জাল কোটা' পাওয়ার জন্য।

চিঠিতে বলা হয়, 'পরবর্তীতে নিয়োগের অনুমোদন নিতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশন এবং বাংলাদেশি সিন্ডিকেট এজেন্টদের পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। প্রবাসী কর্মীরা অভিবাসনের জন্য সিন্ডিকেটের কাছে উড়োজাহাজ ভাড়া, পাসপোর্ট ও ভিসার খরচ ছাড়াও প্রকৃত নিয়োগ খরচের চেয়ে অনেক বেশি ফি দিয়ে থাকেন।'

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের প্রতারিত করা হচ্ছে এবং জনপ্রতি সাড়ে চার থেকে ছয় হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়োগ ফি নেওয়া হচ্ছে। যা ২০২১ সালে এই দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) খেলাফ। ওই এমওইউ অনুযায়ী, এই ফি হবে ৭২০ ডলার পর্যন্ত।

চিঠিতে লেখা হয়েছে, 'মালয়েশিয়ায় কাজ করতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ নিয়োগ ফি প্রদান করেন, যা বাজারে প্রচলিত হারের চেয়ে অনেক বেশি।'

এক নজরে:

১. একজন অভিবাসী সাড়ে ৪ থেকে ৬ হাজার ডলার দেন, যা 'বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ নিয়োগ ফি'।

২. জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ গত ২৮ মার্চ চিঠিটি দেন।

৩. মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকার এখনো চিঠির বিষয়ে সাড়া দেয়নি।

৪. চিঠিতে উভয় দেশের সরকারকে নিশ্চিত করতে অনুরোধ করা হয়েছে যে অভিবাসীরা যেন তাদের অধিকার দাবি করায় নিয়োগকর্তা, দালাল বা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিশোধের মুখে না পড়ে।

৫. স্বাধীন গবেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় এক থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি বেকার কিংবা বিনা বেতনে বা কম বেতনের কাজ করছেন এবং ঋণগ্রস্ত।

গত ২৮ মার্চের চিঠিটি জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) প্রকাশ করে ২৬ মে। এটি প্রকাশ করার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার চিঠিটি দেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এর জবাব দেয়নি।

জাতিসংঘের যে বিশেষজ্ঞরা চিঠিটি লিখেছেন, তারা হচ্ছেন—টোমোয়া ওবোকাটা, রবার্ট ম্যাককরকোডালে, গেহাদ মাদি এবং সিওবান মুল্লালি।

৬০ দিন পরও কোনো সরকারের কাছ থেকে যেকোনো জবাব পাওয়া গেলে তা মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপন করা হবে।

জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের এক কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, চিঠির জবাব দেওয়ার জন্য ঢাকার নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে মিশন।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মালয়েশিয়া সরকার নির্বাচিত ১০০টি বাংলাদেশি নিয়োগকারী সংস্থার একটি সিন্ডিকেটের অধীনে চাকরির জন্য মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন প্রায় চার লাখ ২২ হাজার বাংলাদেশি। এর আগে সেখানে আরও চার লাখ বাংলাদেশি কর্মরত ছিলেন।

স্বাধীন গবেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় এক থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি এখন বেকার, বিনা বেতন বা কম বেতনে কর্মরত এবং ঋণগ্রস্ত।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি অপরাধী নেটওয়ার্ক কাজ করে। তারা কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে এবং ভুয়া কোম্পানিতে নিয়োগ দেয়। সেইসঙ্গে কর্মীদের অতিরিক্ত নিয়োগ ফি দিতে বাধ্য করা হয়, যা তাদেরকে ঋণগ্রস্ত করে তোলে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, 'অভিবাসীদের শোষণমূলক নিয়োগের সঙ্গে জড়িত নিয়োগকর্তা, এজেন্ট ও সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।'

এতে আরও বলা হয়, 'অনেক অভিবাসী মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেখেন, তাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সেই অনুযায়ী চাকরি নেই এবং তাদেরকে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দেশটিতে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে তারা গ্রেপ্তার, আটক এবং দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।'

তারা আরও শোষণের ঝুঁকিতেও রয়েছেন। মানবিক সংকটে পরে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমন পরিস্থিতি আরও বাড়তে। তাদের জীবন আরও ঝুঁকিতে পড়ার আগেই এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

সম্ভাব্য অভিবাসীরা যাতে তাদের অধিকার দাবি করায় নিয়োগকর্তা, এজেন্ট বা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিশোধের মুখে না পড়েন, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তারা উভয় দেশের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উভয় সরকারের কাছে এ বিষয়ে তদন্ত, অপরাধীদের বিচার এবং নৈতিক নিয়োগের নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন।

Comments