দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই ৫ নৌপথে চলছে ৩১ সানকেন ডেক লঞ্চ

এই লঞ্চগুলোকে অনেক আগেই বিশেষজ্ঞরা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছেন। তবু ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ লঞ্চমালিকরা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে এসব লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন বাড়িয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
প্রতি মুহূর্তে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জসহ পাঁচটি নৌপথে অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন ৩১টি সানকেন ডেক (ছোট আকারের যাত্রীবাহী লঞ্চ) লঞ্চ।
মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে যাত্রার অপেক্ষায় ২০২২ সালে ডুবে যাওয়া সানকেন ডেক লঞ্চ এমএল আফসার উদ্দিন। ছবি: তানজিল হাসান/স্টার

প্রতি মুহূর্তে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জসহ পাঁচটি নৌপথে অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন ৩১টি সানকেন ডেক (ছোট আকারের যাত্রীবাহী লঞ্চ) লঞ্চ।

এই লঞ্চগুলোকে অনেক আগেই বিশেষজ্ঞরা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছেন। তবু 'বিশেষ ব্যবস্থায়' লঞ্চমালিকরা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে এসব লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন বাড়িয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

২০২২ সালের ২০ মার্চ দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট অংশে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন রূপসী-৯ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মুন্সীগঞ্জগামী এমএল আফসার উদ্দিন ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া ওই লঞ্চটি ছিল একটি পুরোনা সানকেন ডেক লঞ্চ। ওই দুর্ঘটনায় মোট ১০ জন নিহত হন।

এ ঘটনার পরদিন থেকে নারায়ণগঞ্জ থেকে পাঁচটি নৌপথে এসব লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। এরপর ৩ এপ্রিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও লঞ্চ মালিকের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানেও নিরাপত্তার স্বার্থে নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী সানকেন ডেকবিশিষ্ট এসব লঞ্চ চালুর অনুমতি দেওয়া সমীচীন হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়।

কিন্তু ২৪ এপ্রিল এসব রুটে চলাচলকারী ৭০টি লঞ্চের মধ্যে ১৮ লঞ্চ চলাচলের অনুমতি পায়। বাকি ৫২টি লঞ্চের চলাচল বন্ধ থাকে। এখন এসব রুটে মোট ৩১টি সানকেন ডেক লঞ্চসহ মোট ৩৪টি লঞ্চ চলাচল করছে।

এর আগেও ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকায় (তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছে) এসকেএল-৩ কার্গো জাহাজ পেছন থেকে ধাক্কা দিলে মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসান ডুবে ৩৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, শুরুতে সানকেন ডেক থেকে এক বছরের মধ্যে হাইডেকে রূপান্তরের শর্তে মালিকদের লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দুই বছরেও মালিকরা সেই শর্ত পূরণ করেননি।

সানকেন ডেক লঞ্চ ইরানী’র ভেতরের অংশ। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বয়ার সংখ্যা মাত্র তিনটি। ছবি: তানজিল হাসান/স্টার

সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা যায় পল্টুনে যাত্রার উদ্দেশে অপেক্ষায় আছে ২০২২ সালে ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমএল আফসার উদ্দিন। লঞ্চটিতে ঘুরে দেখা যায়, এর নিচের ডেকে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য মাত্র ১১টি বয়া আছে। অথচ এর যাত্রীধারণ ক্ষমতা শতাধিক। পাশে যাত্রার অপেক্ষায় থাকা আরেকটি সানকেন ডেক লঞ্চ ইরানী'তে বয়ার সংখ্যা ছিল মাত্র তিনটি।

সেখানে কথা হয় নারায়ণগঞ্জগামী যাত্রী মিথুনের সঙ্গে। মিথুন বলেন, 'পরপর দুই বছরে দুটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর পুরাতন ছোট লঞ্চগুলোর চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন আমরা ভেবেছিলাম এই রুটে নতুন বড় লঞ্চ নামবে। কিন্তু সেটা আজ অবধি হয়নি। বরং ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চগুলোই চলছে।'

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই বছরে এই পাঁচটি নৌপথে যাত্রীসংখ্যা কমেছে। আগে এসব রুটে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় হাজার যাত্রী চলাচল করত। এখন তা অনেক কমে এসেছে।

২০২২ সালে দুর্ঘটনার শিকার সানকেন ডেক লঞ্চ এমএল আফসার উদ্দিনের মালিক দিল মোহাম্মদ কোম্পানির কাছ থেকে জানা যায়, বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ রুটে ছয়টি লঞ্চ চলাচল করছে। আগে চলত ২৪টি। মালিকরা ১৮টি লঞ্চ স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করে দিয়েছে। কারণ, সড়কপথে যাত্রী চলাচল বেড়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মীর তারেক আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এ পর্যন্ত একাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এসব লঞ্চ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, মোটেও নিরাপদ নয়। যাত্রীবাহী নৌযানের প্রথম শর্ত হচ্ছে লঞ্চের ডেক ওয়াটার টাইট হতে হবে। কিন্তু, সানকেন ডেক নৌযানের ডেক ওয়াটার টাইট নয়। যাত্রীদের লঞ্চের খোলের মধ্যে পরিবহন করা হয়। যদি কোনো কারণে লঞ্চ ডুবে যায় তাহলে যাত্রীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না।'

এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'রুট পারমিটেও বলা আছে যে এসব লঞ্চ শান্ত নদীতে চলবে। কিন্তু, বর্তমানে যে রুটে লঞ্চগুলো চলছে তা শান্ত নদী নয়। তাই এ লঞ্চগুলো এসব রুটের জন্য সম্পূর্ণ আনফিট ও ঝুঁকিপূর্ণ।'

যদিও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোনের সভাপতি বদিউজ্জামান বাদলের ভাষ্য, অনুমোদন নেওয়ার পর থেকে তাদের লঞ্চগুলো ৪০ বছর পর্যন্ত চলতে পারবে। সে হিসেবে কোনো কোনো লঞ্চের মেয়াদ এখনো ১০-১৫ বছর বাকি আছে।

বদিউজ্জামান বলেন, 'বাংলাদেশের ৮০ ভাগ লঞ্চ সানকেন ডেক। সরকার যদি মনে করে লঞ্চ ব্যবসা বন্ধ করে দেবে তাহলে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা লঞ্চগুলোকে আধুনিক ও দ্রুতগামী করতে চাই। এজন্য সরকারের কাছে আবেদনও করেছি। আর্থিক সহায়তা চেয়েছি। কিন্তু আমাদের মডিফিকেশন নকশার অনুমোদন দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।'

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের উপপরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের কাছে আবেদন করে মালিকপক্ষ এসব লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন নিয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এই অনুমোদনের মেয়াদ আছে। এরপর অনুমোদনের মেয়াদ বাড়ানো না হলে লঞ্চগুলো আর চলতে পারবে না। ফলে এই নৌরুটগুলো যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ আমাদের পক্ষেও এসব রুটে কোনো নৌযান চালানো সম্ভব নয়।'

Comments