‘এটাই আমাদের কোরবানি’

‘আমরা গরুটা বড় করলাম, পাললাম। আমাদের কষ্ট লাগে।’
গরু নিয়ে হাটে সজীব মোল্লা। ছবি: স্টার

'আমরা কৃষক পরিবার, বংশ পরম্পরায় গরু পালি। এবার হাটে যে গরুটা এনেছি ওর বয়স আড়াই বছর। ওর জন্ম হয়েছে আমাদের গোয়ালে। ওর মাও আমাদের গোয়ালে জন্ম নিয়েছে, বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকে এই গরু বড় করলাম। বিক্রি করতে কষ্ট লাগে, কিন্তু কী করব? আমরা নিরুপায়।'

কথাগুলো বলছিলেন ২১ বছর বয়সী সজীব মোল্লা। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থেকে বাবা আলেপ মোল্লার সঙ্গে রাজধানীর রহমতগঞ্জ গরুর হাটে গরু নিয়ে এসেছেন তিনি।

শনিবার রাতে সরেজমিনে ওই গরুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, মনমরা হয়ে বসে আছেন সজীব। জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটু আগে আমার মা ফোন করেছিল। প্রতিবেশীর ফোন থেকে ভিডিওকলে গরুটাকে দেখতে চাইল। কিন্তু দেখাতে পারলাম না।'

'মা প্রতিদিন কয়েকবার করে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে। গরুকে কী খাওয়ালাম, টাইট করে যাতে না বাঁধি, যেন একটু আদর করে দেই, গরু যদি পাগলামি করে তাহলেও যেন ধৈর্য ধরে থাকি—এসব বলে। বলেছে, যদি হাটে দাম কম বলে তাহলে বিক্রি না করে ফিরায় নিয়ে যেতে,' সজীব বলেন।

কান্নাবিজরিত কণ্ঠে সজীব বলেন, 'এই গরু আড়াই বছর আগে আমাদের গোয়ালে জন্মেছিল। তখন থেকে প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে গরুকে সময় দিয়েছি। দূরে বিলের পাড়ে নিয়ে চরিয়েছি। যখন বিলে ঘাস কম থাকে তখন কচুরিপানা, ঘাস এগুলো অন্য জায়গা থেকে কেটে এনে দিয়েছি। আমার মা প্রতিদিন গরুকে গোসল করিয়েছে। গোয়ালে খেতে দেওয়া, মলমূত্র পরিষ্কার সবই মা করেছে।'

'যখন রওনা দিই, এর আগে মা গরুকে খাইয়ে দিয়েছে। গায়ে তেল দিয়ে আদর করে দিয়েছে। ও তখন কাঁদছিল। মা তার চোখ মুছে দিয়েছে। বারবার বলে দিয়েছে, ঠিকমতো নিয়ে যাইস। পথে যেন কষ্ট না হয়।'

গত বছরের স্মৃতি স্মরণ করে সজীব বলেন, গত বছর একটা পালা গরু বিক্রি করেছি ৯০ হাজার টাকায়। তখন মনটা ভেঙে গিয়েছিল। নিজের পালা গরু আরেকজনের হাতে তুলে দিলাম। কে নিল, কোন জায়গায় নিল আমি জানতেও চাই নাই। জানি যে, কোরবানি হয়ে যাবে। মায়া পড়ে যায়, কষ্ট লাগে, তবু এটা করতে হয়।

'কারণ আমরা গরিব। সংসারে অভাব, তার ওপর পাওনাদার। নিজেদের সামান্য একটু জমি আছে। বেশিরভাগ পরের জমিতে কাজ করি। দুই-তিনটা গরু পালি। গাভীর দুধ বিক্রি করি। যে রুজি-রোজগার এ দিয়ে ১২ মাস চলা যায় না। সারাবছরের খরচ মেটাতে হয় এই একটা-দুইটা গরু বিক্রি করে। এইজন্য আমরা বাধ্য বিক্রি করতে।'

একই কথা জানান গরুবিক্রেতা মিজান (৪০)। ফরিদপুর চর ভদ্রাসন থেকে তিনটি গরু এনেছেন তিনি। আড়াই বছর করে বয়স।

তিনি বলেন, 'আমার মা খোদেজা বেগম, তার ৬০ বছরের বেশি বয়স। তিনি ৩০ বছর ধরে গরু পালেন। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে উঠে গরুকে খাওয়ান। নদীর পাড়ে নিয়ে যান। গোসল করান। চোর যাতে না নেয় এজন্য পাহারা দেন, সবসময় সতর্ক থাকেন। হাটে আনার পর থেকে মা কিছুক্ষণ পরপর ফোন করছে। খোঁজ নিচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এর মূল কারণ তো টাকাই। নাহলে এই কষ্ট কেন সহ্য করব? আমার বাবা মারা গেছেন আট বছর আগে। আমরা তিন ভাই, এক বোন। আমার পরিবার ঋণগ্রস্ত। বাধ্য হয়ে গরু হাটে আনলাম। গরু কম দামে বিক্রি করব না। ভালো দাম যদি না পাই, এই কষ্ট সার্থক হবে না।'

'আমরা নিজেরা কোনো পশু কোরবানি দেই না। কারণ এটাই আমাদের কোরবানি। যে হাটে এসে কিনে নিয়ে যায়, সে এক-দুইদিন রাখে। তার তো খারাপ লাগে না। আমরা গরুটা বড় করলাম, পাললাম। আমাদের কষ্ট লাগে। এটাই আমাদের কোরবানি', যোগ করেন মিজান।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus urges countries to engage with 'new Bangladesh'

Highlighting the context of the anti-discrimination student movement and the changes it brought to Bangladesh, Prof Yunus said the "power of the ordinary people", in particular the youth, presented to the nation an opportunity to overhaul many of the systems and institutions

7h ago