১২ বছরে পিএসসির অন্তত ৩০টি প্রশ্নফাঁস

সিআইডির সন্দেহ, পিএসসির আরও অনেকে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত।
ছবি: সংগৃহীত

সরকারি কর্ম কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে জড়িত একটি সিন্ডিকেট গত ১২ বছরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাসহ সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার অন্তত ৩০টি প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে।

তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, প্রায় দুই দশক ধরে এই সিন্ডিকেট সক্রিয়।

এমন তথ্য জানা গেছে সিআইডি কর্মকর্তা এবং প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে পল্টন থানায় দায়ের করা প্রথম তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) থেকে।

এ পর্যন্ত পিএসসির ছয় কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছে পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী—যিনি প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৪ সালে চাকরি হারান।

পিএসসি থেকে চাকরি চলে গেলেও আবেদ আলীর প্রশ্নফাঁসের কার্যক্রম থেমে থাকেনি। তিনি এই সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং তার ছেলেকেও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত করেছিলেন।

গত সোমবার রাতে ৩১ জনের নামে এবং অজ্ঞাত ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে এ বিষয়ে মামলাটি করে সিআইডি। এফআইআরে বলা হয়েছে, অন্তত ১৪ জন অভিযুক্ত পলাতক রয়েছেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, পিএসসির অন্তত দুইজন উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ও আবু জাফর এবং সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির ও সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায় এর সঙ্গে জড়িত।

জাহাঙ্গীর, জাফর ও আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হলেও নিখিল এখনো পলাতক।

এই কর্মকর্তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পিএসসির ডিসপ্যাচ রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলামের মাধ্যমে আবেদ আলীর হাতে তুলে দিতেন।

পিএসসির এসব সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেক বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন বলে জানা গেছে।

তাদের মধ্যে অনেকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হলেও রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক এলাকায় জায়গা এবং দামি গাড়ির মালিক।

গত তিন মাসে এই সিন্ডিকেট সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সহায়তায় সিআইডি ১৭ আসামির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি জব্দ করেছে।

এসব নথি পর্যালোচনা করে একাধিক অর্থপাচার মামলা হতে পারে বলে সূত্র জানায়।

সিআইডির সাইবার তদন্ত ও অপারেশনের বিশেষ সুপার তৌহিদুল ইসলাম মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে পিএসসি কর্মকর্তাসহ ১৭ জন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।'

আরও কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গেও এই সিন্ডিকেট জড়িত ছিল বলে জানান তিনি।

এই সিন্ডিকেট কবে থেকে প্রশ্নফাঁস শুরু করেছে, জানতে চাইলে তৌহিদুল বলেন, 'গ্রেপ্তারকৃত পিএসসি কর্মচারীদের একজন ১৯৯৭ সালে কমিশনে যোগ দেন এবং এর পাঁচ বছরের মধ্যে প্রশ্নফাঁস শুরু করেন।'

তিনি বলেন, 'আমরা তদন্ত করছি এবং অভিযুক্ত বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছি।'

বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদুল বলেন, 'আমাদের কাছে তথ্য আছে। তবে সেগুলো যাচাই করতে হবে।'

সিআইডি সূত্র জানায়, তাদের সন্দেহ পিএসসির আরও অনেকে এর সঙ্গে জড়িত।

জিজ্ঞাসাবাদে সাজেদুল জানিয়েছেন, তিনি পরীক্ষার একদিন আগে জাফরের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেতেন এবং সিন্ডিকেটের দুই সদস্য সাখাওয়াত হোসেন ও তার ভাই সিয়াম হোসেন ঢাকায় ফ্ল্যাটে পরীক্ষার্থীদের সেই প্রশ্নপত্র অনুযায়ী পড়াতেন।

সূত্র জানায়, আবেদ আলী ও তার ছেলের কাজ ছিল প্রশ্নপত্র কিনতে আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের নিয়ে আসা।

সূত্র জানায়, গাইবান্ধার বাসিন্দা পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীরের গ্রামে একটি বাড়ি ছাড়াও ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে তার একটি দুই হাজার বর্গফুটের সুসজ্জিত ফ্ল্যাট রয়েছে। গত ৭ জুলাই রাতে সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

এ ছাড়া, রাজধানীর মিরপুর ও ভাটারায় জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।

তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে তার তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ১৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তবে কখন এসব লেনদেন করা হয়েছে সে তথ্য জানায়নি সূত্র।

গত ৫ জুলাই রেলের পরীক্ষা চলাকালীন তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়।

পিএসসির উপপরিচালক জাফর পটুয়াখালীর বাসিন্দা। তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে থাকেন। তবে মোহাম্মদপুরে তার একটি জমি ও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

জাহাঙ্গীর ও জাফর রাজধানীর মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায় চাকরিপ্রার্থীদের জন্য একটি কোচিং সেন্টার চালান। এর নাম জ্যোতি কমার্শিয়াল সেন্টার। জাফরের স্ত্রীর নামে এই কোচিং সেন্টারের নামকরণ করা হয়েছে।

কোচিং সেন্টারটির পরিচালক আসমা বেগম এবং হুমায়ুন কবিরও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের ক্রেতা সংগ্রহ করতেন।

গ্রেপ্তারকৃত ১৭ জনের মধ্যে ছয় জন গতকাল ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি ১১ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আবেদ আলী, খলিলুর, সাজেদুল, সাখাওয়াত, সিয়াম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিটন সরকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এ ঘটনার পর গতকাল সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর, জাফর, আলমগীর, সাজেদুল ও খলিলুরকে সাময়িক বরখাস্ত করে পিএসসি।

প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ তদন্তে যুগ্ম সচিব আব্দুল আলীম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পিএসসি।

কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন—পিএসসির পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল হক ও দিলওয়াজ দুরদানা।

এই কমিটিকে ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন গতকাল তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলে রেলওয়ে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করা হবে।

পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে গতকাল পিএসসির আগারগাঁও কার্যালয়ের সামনে চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশের পর তার এমন ঘোষণা আসে।

 

Comments