শহরজুড়ে ব্লক রেইড, আতঙ্কে নগরবাসী

আতঙ্কিত মানুষ বাহিনীর সদস্যদের কথা মতোই ঢুকে যায় যে যার ঘরে—শুরু হয় ব্লক রেইড।
ব্লক রেইড
ঢাকা কলেজের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাজধানীর সিএমএম আদালতে হাজির করা হলে ফাইয়াজের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বুধবার রাতে ফাইয়াজকে তার যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সাম্প্রতিক সহিংসতায় বিপর্যস্ত এই শহরের মানুষ নতুন করে প্রত্যক্ষ করছেন আরেক ভীতিকর দৃশ্য।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে তাদের এলাকায়—কখনোবা সূর্যাস্তের পর। বাহিনীর সদস্যরা গাড়িগুলো থেকে তড়িৎগতিতে লাফিয়ে নামছে, মুহূর্তেই ঘিরে ফেলছে এলাকা, অবস্থান নিচ্ছে বিভিন্ন পয়েন্টে। কখনো হাতে শক্ত করে ধরা বন্দুক, তর্জনী ট্রিগারে।

'আপনার বাসার ভেতরে যান, বাইরে আসার চেষ্টা করবেন না'—মেগাফোনের এই ঘোষণা ভবনের দেয়ালগুলোতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এলাকা জুড়ে।

আতঙ্কিত স্থানীয় মানুষ বাহিনীর সদস্যদের কথা মতোই ঢুকে যায় যে যার ঘরে—শুরু হয় ব্লক রেইড।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টার্গেট করা বাড়ির ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং রাস্তার আলো একে একে নিভে যায়। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িতে লাগানো বাতি জ্বলতে থাকে। পরবর্তী এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ডাকা হয় অতিরিক্ত বাহিনী, যারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান শুরু করে।

এভাবেই রাজধানীর অন্তত আটটি এলাকার বাসিন্দা তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের কাছে।

সাম্প্রতিক সহিংসতায় অন্তত ১৬২টি তাজা প্রাণ ঝড়ে যাওয়া দেখে যাদের ট্রমা এখনো কাটেনি, তাদের সামনে আবার এমন দৃশ্য আরও বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।

এসব অভিযান চালানো হয়েছে—মাতুয়াইল, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, বসুন্ধরা, শাহিনবাগ, মিরপুর ডিওএইচএস, ইসিবি চত্বর ও মাটিকাটা এলাকায়।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে, অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দরজায় কড়া নাড়ছে, ভেতরে প্রবেশ করছে এবং সহিংসতার সঙ্গে জড়িত বা তাদের সংস্পর্শে থাকা সন্দেহভাজন কাউকে পেলে গ্রেপ্তার করছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্লক রেইড চালাচ্ছে যৌথবাহিনী।

প্রধান লক্ষ্য শিক্ষার্থী

গতকাল শনিবার পর্যন্ত পুলিশ দুই হাজার ৫৩৬ জনকে এবং র‌্যাব ৭১ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, 'অভিযান পরিচালনা করার আগে আমরা সংঘর্ষ সৃষ্টিকারী ও তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি এবং তাদের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট সংগ্রহ করছি।'

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এই ব্লক রেইড চলছে চার ধরনের সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করার জন্য—যারা সহিংসতার নির্দেশ দিয়েছে, তহবিল দিয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েছে এবং যারা সহিংসতায় অংশ নিয়েছে।

তবে অভিযান প্রত্যক্ষ করা স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের খোঁজ করছে এবং শিক্ষার্থী কাউকে পেলে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করছে, যা বেআইনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, 'গত শুক্রবার রাতে পাঁচটি ট্রাকে করে অসংখ্য পুলিশ এবং অনেক পুলিশ ভ্যান ও অন্যান্য গাড়ি আমাদের এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা বিভিন্ন ভবন থেকে শিক্ষার্থীদের বাইরে এসে রাস্তায় এক সারিতে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। সড়কের বাতি বন্ধ ছিল কিন্তু তাদের গাড়ির হেডলাইটগুলো আমাদের দিকে তাক করা ছিল। তারা বলেছে এবার আমাদের তারা গ্রেপ্তার করবে না, কিন্তু তিন দিনের মধ্যে আমাদের ঢাকা ছাড়তে হবে।'

পড়াশোনার খরচ চালাতে তাদের অনেককে টিউশনি করতে হয় আর এ কারণে এখন ঢাকা ছাড়তে না পারার কথা জানালে কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের মারধর করেন এবং 'চুপ থাকতে' বলেন।

নিরাপত্তাজনিত কারণে ডেইলি স্টার ওই শিক্ষার্থীর নাম এবং যে এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে সেটি প্রকাশ করছে না।

স্থানীয়রা কয়েকটি অভিযানের সময় অনেক নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন।

'সহায়ক বাহিনী'

বুধবার রাতে যাত্রাবাড়ীর মানিকনগর থেকে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ম্যানেজার ফজলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক আত্মীয় বলেন, 'পুলিশ ফজলুরের মোবাইল ফোন চেক করে সংঘর্ষের একটি ভিডিও ক্লিপ পায়। এ কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করে।'

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, 'কোনো সংঘর্ষ সৃষ্টিকারী যাতে ঢাকা ছেড়ে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে।'

বিপ্লব এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'দুর্বৃত্তরা আত্মগোপনে চলে গেছে, কিন্তু আমরা ব্লক রেইড চালাচ্ছি। এ ছাড়া, ঢাকায় দিনরাত পুলিশি অভিযান চলছে। তারা যেখানেই পালিয়ে থাকুক, আমরা তাদের গ্রেপ্তার করব।'

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সহিংসতায় যোগদানকারী কয়েক হাজার মানুষকে শনাক্ত করা হয়েছে।

ডিএমপির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অন্তত এক মাস আগে বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা সহিংসতা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল।

সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হওয়ায় মহাখালী, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরার মতো এলাকায় বেশি রেইড হচ্ছে।

আটটি বামপন্থি দলের প্ল্যাটফর্ম বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএ), ছয় দলের প্ল্যাটফর্ম ফ্যাসিবাদবিরোধী বামপন্থি অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ জাসদ গতকাল জানিয়েছে, ব্লক রেইডের সময় হেলিকপ্টার থেকে সার্চলাইট জ্বালিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্র ও অন্যান্য লোকজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনা রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য দোসরদের কর্মকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর চিহ্নিত করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়ক বাহিনী হিসেবে সহায়তা করেছিল।

প্ল্যাটফর্মগুলো একটি বিবৃতিতে 'অবিলম্বে দমন, নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ, কারফিউ প্রত্যাহার, সেনা সদস্যদের ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন এবং স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করার' দাবি জানিয়েছে।

চারদিকে আতঙ্ক

ব্লক রেইডের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব আতঙ্কিত পরিবারগুলোর অনেকেই ইতোমধ্যেই তাদের বাড়িঘর ছেড়েছে এবং ঢাকা ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌফিক (ছদ্মনাম) বলেন, 'প্রতিটি রুম তল্লাশি করেছে। তার আগে পুলিশ আমাদের রুমের ও বাড়ির ছবি তুলেছে। তাদের অভিযান সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে গেছে।'

তিনি জানান, তিনি যে ছয়তলা বাড়িতে থাকেন, তার পুরোটিতেই পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে এবং শুক্রবার গভীর রাতে তারা চলে যাওয়ার আগে কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাঙচুর করেছে।

তৌফিক বলেন, 'আমাদের অনেক প্রতিবেশী তাদের রুমের লাইট বন্ধ করে রেখেছে যাতে পুলিশ মনে করে যে ওইসব ফ্ল্যাটে কেউ নেই।'

একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ভবনের প্রধান ফটকে লাথি মারতে থাকে। নিরাপত্তারক্ষী ও বাড়ির মালিক গেট খুললে পুলিশ জানায়, তারা পুলিশের ওপর হামলাকারী শাহজাহান ও রেজওয়ান নামে দুই ব্যক্তিকে ধরতে এসেছেন।

বাড়ির মালিক জানান, ওই ভবনে এমন নামের কেউ থাকে না। তখন সাদা পোশাকের বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা তাদের মারধর শুরু করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।

তারা বলেন, 'আমরা জানি আপনি তাদের লুকিয়ে রেখেছেন। কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বের করেন।'

প্রায় ৫০-৬০ জন সশস্ত্র পুলিশ—তাদের মধ্যে কেউ সাদা পোশাকে এবং কেউ ডিবির কোট পরা ছিল।

তিনি বলেন, 'বারান্দা থেকে দেখেছি, কয়েকজন পুলিশ কয়েক মিনিট ধরে দুজনকে মারধর করেছে, তাদের উঠ-বস করতে বাধ্য করেছে এবং তাদের বলতে বাধ্য করেছে যে তারা আর কখনো কোথাও কোনো ধরনের প্রতিবাদ করবে না।'

আবার হেলিকপ্টার  আতঙ্ক

যাত্রাবাড়ীর অনেক পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই অভিযানের প্রায় একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন।

মাতুয়াইলের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'অভিযানের সময় স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীরাও পুলিশের সঙ্গে ছিল। আন্দোলনকারীরা কোন কোন বাড়িতে থাকে বা আন্দোলনকারীদের জন্য কোন কোন বাড়ি থেকে খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা।'

মিরপুর ১২ ডিওএইচএসের বিভিন্ন বাসায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অভিযান চালিয়েছে। ডিওএইচএসের কাছাকাছি এলাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী সেখানে বসবাস করেন।

তারা জানিয়েছেন, ব্লক রেইডের সময় তারা শিক্ষার্থীদের খোঁজ করেছে এবং শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন চেক করেছে।

ইসিবি চত্বর ও মাটিকাটা এলাকা সংলগ্ন এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, তাদের এলাকায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রেইড চালিয়েছে।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকায় যৌথ অভিযান চালানো হয়। এ সময় স্থানীয়রা হেলিকপ্টারগুলো নিচু দিয়ে উড়তে থাকে এবং সার্চলাইট ব্যবহার করে।

বিক্ষোভকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথা মনে করে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'হেলিকপ্টার থেকে সার্চলাইট ব্যবহার করায় সবাই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি।'

এটা ন্যায়সঙ্গত নয়

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার স্থানীয়রা আরও জানান, বৃহস্পতিবার রাতে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের এলাকায় ব্লক রেইড করতে দেখেছেন। অভিযানের আগে পুলিশ ঘোষণা দিয়েছিল যে বিকেল ৫টার পর কেউ বাড়ির বাইরে থাকবেন না। সন্ধ্যা গড়াতেই সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়তে থাকে।

একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি ভবনের ওপর থেকে কেউ তার মোবাইলে এই অভিযান রেকর্ড করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

মহাখালীতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ব্লক রেইড চালানো হয়।

ভয়ে অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

যেমন যাত্রাবাড়ীতে দ্য ডেইলি স্টার দেখেছে, বেশ কয়েকটি বাড়ি খালি পড়ে আছে।

যাত্রাবাড়ীর এক বাসিন্দা বলেন, 'আমাদের ভবনে ২২টি পরিবারের মধ্যে এখন আছে মাত্র আটটি। বাকি সব পরিবার ঢাকা ছেড়েছে। যারা যেতে পারেননি, তারা অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন।'

তিনি বলেন, 'পুলিশ সাধারণ মানুষকে চরমভাবে নার্ভাস করে তুলছে। এটি কোনোভাবেই ঠিক নয় এবং এটি পরিস্থিতি উন্নতিতে সাহায্য করবে না।'

Comments