রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরা, খাবার-পানি-ছাতা দিয়ে সহযোগিতা করছে রাজধানীবাসী

যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত এক শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবী। ছবি: পলাশ খান/স্টার

তেজগাঁও মডেল হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র হামিদুল ইসলাম। ১৫ বছর বয়সী হামিদুরের যে সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গল্পে মজে থাকার কথা কিংবা নেহাতই ঘরে বসে পড়ার কথা; ঠিক সে বয়সেই স্বেচ্ছায় রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম রাজপথ বিজয় স্মরণীর সিগন্যালে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে সে।

কেবল হামিদুলই নয়, ব্যস্ততম এই সিগন্যালে দেখা মিললো শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

পেশায় অ্যাম্বুল্যান্স চালক জাকির হোসেন তেমনই একজন। জাকির কাজ করেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত রোগী পরিবহনের কাজ শেষে স্বেচ্ছায় অবতীর্ণ হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায়।

আজ বুধবার বিকেলে সরেজমিনে বিজয় স্মরণীর সিগন্যালে দেখা যায়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের কয়েকজন সদস্য, আনসার ও বিমানবাহিনীর এমওডিসির বেশ কয়েকজন সদস্য সড়কের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন।

একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, গণভবন, আসাদগেট, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর সহ বিভিন্ন এলাকায়।  ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার কাজও করছে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।

ছবি: শরীফ এম শফিক/স্টার

গণভবনের সামনের সিগন্যালে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। পার্শ্ববর্তী অরক্ষিত গণভবনের পাহারায় বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন সড়কটি এখন পুরোপুরি বন্ধ। সড়কের একপাশে গত দুদিনে গণভবন থেকে চুরি হওয়া মালামাল ফেরত নিচ্ছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

গণভবনের সম্মুখে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপালনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই ছিল বেশি।

সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল আরোহীদেরও চলাচলে বাধা দিয়ে সতর্ক করছেন শিক্ষার্থীরা।

ফার্মগেটে দুই মোটরসাইকেল আরোহীকে হেলমেট না থাকার কারণে ১০ মিনিট সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখেন তারা।

ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সিগন্যালগুলো ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত নিজ নিজ এলাকা ভিত্তিতেই তারা কাজ করছেন। ফার্মগেট সিগন্যালে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছিলেন শেরে বাংলা সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী সৌরভ। তিনি বলেন, 'ফেইসবুকে এলাকার মেসেঞ্জার গ্রুপ থেকেই আমি জানতে পারি। আজ সকাল ১১টা থেকে কাজ শুরু করেছি। বিকেল ৫টা পর্যন্ত করব।'

কেন কষ্ট করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন জানতে চাইলে সৌরভ বলেন, 'দেশটা তো আমাদেরই। আমাদের আন্দোলন আর ভাইদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। এখন দেশের জন্য এতটুকু করব না! দেশ গড়ার জন্য এই সামান্য কাজটুকু করছি।'

সৌরভ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী তেজগাঁও কলেজ, বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরাও ব্যস্ত সিগন্যালটি সামলাচ্ছিলেন।

রাজধানীর কাওরানবাজার ট্রাফিক সিগন্যালে গিয়ে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ছবি: পলাশ খান/স্টার

এদের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ভালো কাজের হোটেলের স্বেচ্ছাসেবক এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট প্রতিষ্ঠান অ্যাকনাবিনের কর্মীরাও রয়েছেন।

অ্যাকনাবিনের কর্মকর্তা আল আমীন বলেন, 'আমরা আমাদের অফিস থেকেই ঠিক করেছিলাম দুটি শিফটে কাজ করব। আমি ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কাজ করছি। এরপরে আমারই এক সহকর্মী আমার পরিবর্তে কাজ করবেন।'

সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনোরকম নির্দেশনা ছাড়াই ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে কেবলই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেই কাজ করছেন তারা।

শিক্ষার্থীদের এই স্বেচ্ছাশ্রমকে স্বাগত জানিয়েছে রাজধানীবাসী। কয়েকটি রাস্তায় সাধারণ মানুষ শিক্ষার্থীদের খাবার ও পানি বিতরণ করেছেন।

তেমনি একজন ইঞ্জিনিয়ার ফারুক। দুপুরে ফার্মগেটে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের ছাতা বিতরণ করছিলেন তিনি।

ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ঢাকায় থাকি প্রায় ২০ বছর। কিন্তু রাস্তাঘাট এত সুশৃঙ্খল আমি আগে কখনো দেখিনি। এর কারণ হলো সবাই ছাত্রদের শ্রদ্ধা করছে। পুলিশের প্রতি সেই শ্রদ্ধা ছিল না। পুলিশ সবসময় অসাধু উপায় অবলম্বন করত। প্রখর রোদে তারা দায়িত্ব পালন করছে। সেজন্য নিজ খরচে কয়েকটি পয়েন্টের শিক্ষার্থীদের আমি ছাতা কিনে দিয়ে এসেছি।'

গত ৫ আগস্ট গণ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরবর্তীতে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ সদস্যরা হত্যার শিকার হন।

থানায় হামলা ও সহকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে যান ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও। একপর্যায়ে সড়কে যান চলাচল বাড়লে গতকাল থেকেই শূন্য ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে স্বেচ্ছায় দায়িত্বপালনে নেমে পড়েন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে আজ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব জেলার থানাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও আজ রাস্তায় আনসার সদস্যদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। কার্যত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষই সামলাচ্ছেন ঢাকার ব্যস্ততম রাজপথগুলো।

Comments

The Daily Star  | English
A freedom fighter’s journey to Mujibnagar

Who is a freedom fighter

The government's move to redefine freedom fighters has been at the centre of discussion

48m ago