বন্যা মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ২৭ নাগরিকের বিবৃতি

‘সহায়তার দ্রব্য-সামগ্রী বিতরণের সময় দূরবর্তী এবং দুর্গম এলাকার পানিবন্দি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
ফেনীর দাগনভূঞায় বন্যাকবলিত মানুষের ত্রাণ সংগ্রহ করে ফেরার শনিবারের চিত্র। ছবি: স্টার

বন্যা মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে সমন্বিত শক্তি ও সার্মথ্য নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ২৭ জন নাগরিক।

আজ সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এই আহ্বান জানান।

এতে বলা হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ১২টি জেলা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী নিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার এবং জরুরি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র সমাজ এবং অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে সাহায্য সামগ্রী সংগ্রহ করে বন্যার্তদের জন্য পাঠানো হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি। এসব উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের আহ্বানে টিএসসি কেন্দ্রে নগদ অর্থ সহায়তা ও সাহায্য-সামগ্রী নিয়ে আসা অসংখ্য মানুষের ভিড় দুর্যোগ মুহূর্তে আমাদের দেশের সচেতন ও সাধারণ মানুষ যে কতটা সংবেদনশীল এবং অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ও উদগ্রীব, এটা তারই সাক্ষ্য বহন করে। এ ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক খবর ঢাকার বাইরের অনেক জায়গা থেকেও পাওয়া যাচ্ছে।

এই ভয়াবহ বন্যাসৃষ্ট দুর্যোগ মুহূর্ত নাগরিক সমাজের, বিশেষত বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংস্থাগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং বন্যার্তদের পাশে সমন্বিতভাবে দাঁড়াতে বিশেষভাবে আহবান জানাচ্ছি এবং সেইসঙ্গে আরও কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার বিশেষ অনুরোধ জানাই। সেগুলো হলো—

১. যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং শুকনো খাবার, পানীয় জল, পোশাক, জরুরি ওষুধ, নগদ অর্থ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রী দ্রুত সংগ্রহ করে নিকটস্থ শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ত্রাণ কেন্দ্রে পৌঁছানো বা নিজেদের কোনো সমন্বিত কার্যক্রম থাকলে সেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এ ছাড়াও প্রয়োজনে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের সহায়তা নেওয়া।

২. বন্যাকবলিত জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু বিপর্যস্ত হয়নি, পরিবহন খরচও নানা কারণে অত্যধিক বেড়ে গেছে। সে কারণে আলাদা আলাদাভাবে ত্রাণ সামগ্রী বন্যার্তদের কাছে নিয়ে যাওয়ার বদলে সমন্বিতভাবে ওই সব সামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় হবে এবং সহায়তার পরিমাণও বেশি দেওয়া যাবে।

৩. সহায়তার দ্রব্য-সামগ্রী বিতরণের সময় দূরবর্তী এবং দুর্গম এলাকার পানিবন্দি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৪. সামাজিকভাবে যারা বৈষম্যের শিকার, সেসব সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষ যেমন গ্রামীণ নারী, শিশু, অসুস্থ প্রবীণ নারী-পুরুষ, প্রতিবন্ধী, দলিত, আদিবাসী ও তৃতীয় লিঙ্গের কোনো মানুষ থাকলে তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

৫. বন্যা দুর্যোগের সময় অনেক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হতে পারে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। নারীদের যৌন হয়রানির বিষয়টিও এ সময় ঘটতে পারে বলে আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি। এসব বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা এবং কোনো ঘটনার তথ্য পেলে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে যা করণীয় তা দ্রুত করার চেষ্টা করা। এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা চাওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হচ্ছে।

৬. জরুরি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের সময় বন্যার্তদের জন্য মধ্য-মেয়াদি ও দীর্ঘ-মেয়াদি চাহিদা বা প্রয়োজনের তথ্য বা তালিকাও প্রাথমিকভাবে করে ফেলা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রী, আশ্রয়হীনদের অস্থায়ী বা স্থায়ী আশ্রয়, অসুস্থদের চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যাপারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই কাজটিও সমন্বিতভাবে করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

৭. কোন কোন বন্যাপীড়িত এলাকায় সহায়তার কাজে নয়, এক শ্রেণির মানুষ অপ্রয়োজনীয় ভিড় বাড়াচ্ছেন এবং বন্যার্তদের বিরক্তি ও হয়রানির কারণ হয়ে উঠছেন বলে অভিযোগ আসছে। এসব দর্শনার্থীদের বন্যার্তদের এলাকায় যাওয়া রোধ কিংবা নিরুৎসাহিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষার্থী সমাজের প্রতিও আমরা বিশেষ আহ্বান রাখছি।

বিবৃতিতে সইকারীরা হলেন—মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, ঢাবির ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ড. পারভীন হাসান, বিএনডব্লিউএলএর নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর প্রফেসর নায়লা জে. খান, মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, ঢাবির অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সেলভিয়ার পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইদুল ইসলাম, থাইল্যান্ডের মাহিডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজিনা বেগম, সাংবাদিক সাঈদা গুলরুখ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তবারক হোসেইন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, আদিবাসী অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফ আলী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহাদাত আলম এবং সাঙ্গাতের কোর গ্রুপের মেম্বার মুক্তাশ্রী চাকমা।

Comments

The Daily Star  | English
Gazipur factory fire September 2024

Business community's voice needed in the interim government

It is necessary for keeping the wheels of growth running and attracting foreign investment in the new Bangladesh.

13h ago