ধামরাইয়ে বুচাই পাগলার মাজারে হামলা-ভাঙচুর

ধামরাইয়ে বুচাই পাগলার মাজারে হামলা-ভাঙচুর
ধামরাইয়ে বুচাই পাগলার মাজার | ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার ধামরাই উপজেলার বাটুলিয়া এলাকায় 'বুচাই পাগলা (রহ.) এর মাজারে' হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

এলাকাবাসীর দাবি, অন্য এলাকার লোকজন এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।

তারা আরও বলেন, মাজারটিতে শরিয়াহবিরোধী কাজ হতো না। মাজারে মাদক নিষিদ্ধ ছিল। মাজারে দানের টাকায় একটি মসজিদ পরিচালনা করা হতো, দানের অর্থের একটি অংশ যেত মাদ্রাসায় এবং অসহায় মানুষদের সহায়তা করা হতো।

বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পাঁচ শতাধিক মানুষ উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের বাটুলিয়া এলাকায় কালামপুর-সাটুরিয়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে মাজারটি ভাঙচুরে অংশ নেন।

প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত ভাঙচুর চলে। দুপুর আড়াইটার দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

মাজার ভাঙচুরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী মানুষ লাঠি হাতে মাজারের বিভিন্ন সরঞ্জাম ভঙচুর করছেন এবং একটি এক্সাভেটর (ভেকু) দিয়ে মাজারের মূল ভবনটি গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই টুপি ও পাঞ্জাবি পরে ছিলেন।

ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, মাজারটির তিনটি ইটের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে চারপাশের সীমানা দেয়াল। ছাদের পাঁচটি গম্বুজের মধ্যে তিনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। মাজারের পাশে একটি টিনের কক্ষ ভেঙে ফেলা হয়েছে। লুট করা হয়েছে মালপত্র। মাজারের অদূরে থাকা আরও একটি টিনের কক্ষ এবং ভক্তদের বিশ্রামের জন্য তৈরি করা সেমি পাকা ভবন ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে।

এই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন কুশুরা দক্ষিণ কান্টাহাটি মসজিদের ইমাম মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'এখানে শিরক-বিদাতি কাজকর্ম চলছিল, কোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে পারছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ, এখন প্রতিরোধ করার সময় হয়েছে। এখন যদি বসে থাকি, তবে কেয়ামতের ময়দানে হিসাব দিতে হবে। যে কারণে আমরা ধামরাইয়ের আলেম-ওলামারা বিভিন্ন সংগঠন থেকে একত্রিত হয়ে এটি বন্ধ করি। ধামরাই ওলামা পরিষদ, ইমাম পরিষদ, কালামপুর আঞ্চলিক ইমাম পরিষদ এখানে ছিল।'

হামলার সমন্বয়ক দাবি করেছেন আবুল কাশেম। তিনি বলেন, 'এখানে অনেক আগে থেকে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তবে জনগণ প্রতিবাদ করতে পারেনি। এখানে মদ, গাঁজা সেবনসহ নানা অনৈতিক কাজ হতো। কালামপুর ও আশপাশের তৌহিদি জনতা সবাই একত্র হয়ে এটি ধ্বংস করেছে।'

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, এই মাজারে শরিয়াহবিরোধী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হতো। মাজারে সিজদাহ করতে দেওয়া হতো না। নির্দেশনা টানানো ছিল। মাজারের দানবাক্স সপ্তাহে এক দিন সবার সামনে খোলা হতো। দানের অর্থে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছে, ইমামের বেতন দেওয়া হতো মাজারের অর্থে। এছাড়া মাদ্রাসায় আর্থিক সহায়তায় ও মানুষের কল্যাণে এই অর্থ ব্যয় করা হতো।

ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীর আলমের (৫৫) সঙ্গে। মাজারের বিপরীত পাশের বাড়িটি তার। জাহাঙ্গীর বলেন, 'এলাকার একটি লোকও মাজার ভাঙার সঙ্গে জড়িত ছিল না। কেউ বুঝতেই পারেনি। এই মাজারে শরিয়াহবিরোধী কোনো কাজ-কর্ম আমরা কখনো করতে দেইনি। মাদক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'মাজার নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে উপজেলা প্রশাসন কিংবা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে পারতো। দূরের লোকজন এসে যেভাবে মাজার ভাঙলো, এটা অন্যায়।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রত্যাক্ষদর্শী বলেন, 'মাজারে মারফতি গান-বাজনা হয় বছরে এক মাস। এছাড়া আর কিছু হয় না। মাজারের দানের অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় হতো। হিসাব ছিল স্বচ্ছ। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কিছুই করতে পারলাম না। খুব খারাপ লাগছে।'

তিনি আরও বলেন, 'মাজারে তো কাউকে ডেকে আনা হয় না। ভক্ত-অনুসারীরা নিজের ইচ্ছায় আসেন। কাউকে হয়রানিও করা হয় না। এটা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।'

বিকেলে বাটুলিয়া এলাকার শতাধিক মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

বাটুলিয়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন বুচাই পাগলা। কথিত আছে, কিশোর বয়সেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তবে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক নানা গুণ ছিল। সেই কারণে ধীরে ধীরে তার ভক্ত-অনুসারী তৈরি হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর কালামপুর-সাটুরিয়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তার কবর ঘিরেই গড়ে ওঠে মাজার। প্রতি বছর সেখানে ওরশ ও মাসব্যাপী মেলা আয়োজন করা হয়। তাতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ অংশ নেন।

মাজারের অর্থে পরিচালিত জামে মসজিদে গত এক যুগ ধরে ইমামতি করছেন মো. সোহেল মাহমুদ।

তিনি বলেন, 'এই মাজারে শরিয়াহবিরোধী কর্মকাণ্ড আমরা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতাম। সিজদাহ করতে দেওয়া হতো না। মাজারের দানবাক্সের টাকা মানুষের জন্য ব্যয় করা হতো। তারা যেভাবে এটি ভাঙচুর করেছে, এটাই ইসলামবিরোধী কাজ। এলাকার মানুষ খুবই কষ্ট পেয়েছে।'

ঘটনাস্থলে উপস্থিত সানোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. তিতুমীর হোসেন বলেন, 'ইউএনও স্যারের ফোন পেয়ে দুইজন চৌকিদার নিয়ে এখানে এসেছিলাম। তবে তাদের সামনে যেতে পারিনি। পরে সেনাবাহিনী এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।'

ধামরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি প্রশান্ত বৈদ্য বলেন, 'ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। দুপুরের দিকে যারা মাজারটি ভাঙচুর করেছে তারা এখানে আসেন। তারা কিছু দাবি-দাওয়া জানিয়েছেন। তাদের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বৈঠক করবেন। আপাতত তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English
Government notification banning Awami League

Govt issues gazette notification banning AL activities

A Public Security Division joint secretary confirmed the matter

1h ago