মানুষের মুক্তির পক্ষে বিশ্বজুড়ে প্রেরণা যোগাবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান: জাতিসংঘে ড. ইউনূস

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন। আজ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে বিশ্বনেতাদের সামনে বক্তব্য দেন তিনি।

ভাষণের শুরুতেই জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের একটি প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন অধ্যাপক ইউনূস।

বাংলাদেশে যে বিশেষ প্রেক্ষাপটে তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে সেই কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্বসম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের, অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথে এবং সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

আমাদের ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি এনে দিয়েছে। তাদের এই সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত, যা এ দেশটিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছে।

আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও, বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের এই তরুণরা। তারা অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল। স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করে তাদের জীবন।

শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে। তপ্ত রোদ, বৃষ্টি, মৃত্যুভয়কে তোয়াক্কা না করে তারা সত্য ও ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ব্যাপী রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনা করার অশুভ ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করেছিল।

জনগণের এই আন্দোলনে আমাদের জানা মতে, স্বৈরাচারী শক্তির হাতে আটশর বেশি জীবন আমরা হারিয়েছি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের 'জেনারেশন জি' নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এরকম আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়েও।

বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি তাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য আমাদের তরুণেরা এবং দেশের আপামর জনসাধারণ আমার এবং আমার উপদেষ্টা পরিষদের উপর আস্থা রেখে সরকার পরিচালনার এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা গভীর বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একাটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দী করে রাখা হয়, কীভাবে জনগণের অর্থসম্পদ লুটপাট করা হয়, কীভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এককথায়, প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

এরকমই এক অবস্থায় দেশকে পুনর্গঠন এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য।

তিনি বলেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানাই।

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা প্রমাণ করেছে যে, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার অভিপ্রায় কোনো উচ্চাভিলাস নয়। বরং, এটা সকলের নিশ্চিত প্রাপ্য।

আজ এই মহান সমাবেশে আপনাদের উপস্থিতিতে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ তার ভূমিকাকে ক্রমাগতভাবে জোরদার করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English
Former president Hamid airport CCTV footage

The story of Hamid’s exit

Security footage obtained and analysed by The Daily Star shows that Hamid's car reached the barrier gate of the VIP terminal at 12:46am on May 8

11h ago