গণ-অভ্যুত্থানে নিহত মেয়ের এইচএসসির ফলই শেষ স্মৃতি

নিহত মেয়ে নাফিসার ছবির অ্যালবাম দেখছেন মা কুলসুম। ইনসেটে নাফিসার কলেজের পরিচয়পত্র। ছবি: আকলাকুর রহমান আকাশ/স্টার

এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। টঙ্গীর সাহাজ উদ্দিন সরকার মডেল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী নাফিসা পাস করেছেন। কিন্তু তিনি শুয়ে আছেন অন্ধকার কবরে।

গত ৫ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা এলাকায় গণভবন অভিমুখী ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)।

এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি জিপিএ ৪.২৫ পেয়ে কৃতকার্য হয়েছেন। ফলাফল পেয়ে নাফিসার পরিবারে আনন্দের পরিবর্তে বেদনা ভোর করেছে। কারণ যাকে নিয়ে আনন্দ উৎযাপিত হবে তিনিই নেই। 

নাফিসার মা কুলসুম বেগম কুয়েতপ্রবাসী। বাবা আবুল হোসেন টঙ্গীতে থাকেন। বাবার কাছে থেকে টঙ্গীতে লেখাপড়া করতেন নাফিসা। গত ৩১ জুলাই সাভারের বক্তারপুর এলাকায় নানা বাড়িতে বেড়াতে আসেন নাফিসা। সেখান থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন তিনি।

আজ বুধবার দুপুরে নাফিসার নানা বাড়ি বক্তারপুর গিয়ে দেখা যায়, নাফিসার মা কুলসুম বেগম, ছোট মামা হযরত আলী একটি ঘরে বসে আছেন। নাফিসার হাসপাতালের রিপোর্ট, মৃত্যু সনদ, বিভিন্ন শিক্ষা সনদ দেখছেন আর নিরবে কাঁদছেন মা কুলসুম বেগম।

নাফিসার মামা মো. হযরত আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নাফিসা মাধ্যমিক পর্যন্ত আমাদের এখানেই পড়েছে। মাধ্যমিক পাস করার পর টঙ্গীতে গিয়ে ভর্তি হয়। গত ৩১ জুলাই টঙ্গী থেকে আমাদের বাড়িতে আসে নাফিসা। পূর্ব পরিচিত সহপাঠীদের সঙ্গে ৪ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয় সে।'

'বাঁধা দিয়ে ফেরাতে পারিনি তাকে। পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ৮টায় বাসা থেকে আবারও বের হয় নাফিসা। বাধা দিলে আমাকেও আন্দোলনে যেতে বলে,' বলেন মামা হযরত।

পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের গুলি করছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 'আমার ভয় হচ্ছিল। আমি ওকে (নাফিসা) যেতে না করলাম। কিন্তু আমার বাধা না শুনে চলে গেল। সাড়ে ১০টার দিকে ওর সঙ্গে ফোনে কথা হলো। বলল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, নিরাপদে আছে। বিকেল ৩টার দিকে ওর নম্বরে কল করলে আরেকজন রিসিভ করে বলে মোবাইলটি যার সেই আপা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ল্যাবজোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে,' বলেন হযরত।

তিনি আরও বলেন, 'এই খবরে দৌড়ে ল্যাবজোন হাসপাতালে যাই। চিকিৎসকরা জানায় নাফিসা মারা গেছে। পরে এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানকার চিকিৎসকরাও জানালো যে নাফিসা মারা গেছে। চারদিকে গুলির শব্দ। নাফিসার লাশ নিয়ে থানার দিকে যেতে থাকে শিক্ষার্থী-জনতা। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে নাফিসার মরদেহ সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে রিকশায় মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসি। এখানে জানাজা শেষে টঙ্গীতে নিয়ে তাকে কবর দেই।'

নাফিসার মা কুলসুম বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুই মেয়ের সূন্দর ভবিষ্যতের জন্য গত ২০ বছর ধরে বিদেশে থাকি। কষ্টের আয়ে দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছিলাম। বড় মেয়ে নাফিসা মারা গেল। ওর কত স্বপ্ন ছিলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, ভালো ফটোগ্রাফার হবে। ভালো আয় করবে, আমার জন্য একটা বাড়ি বানাবে। ওর সব স্বপ্ন শেষ।'

'গতকাল রেজাল্ট দিয়েছে। ভালো রেজাল্ট করেছে মা। ভালো রেজাল্ট দিয়ে কী হবে, যার রেজাল্ট সেইতো নেই। এই রেজাল্টই আমার মেয়েটার শেষ স্মৃতি,' বলেই কান্নায় ভেঙে পরেন কুলসুম বেগম।

Comments

The Daily Star  | English
political reform in Bangladesh

Pathways to a new political order

The prospects for change are not without hope in Bangladesh.

10h ago