বিদায় বন্ধু অ্যান্ড্রু!

অ্যান্ড্রু জেমস ঈগল
অ্যান্ড্রু জেমস ঈগল। ছবি: সংগৃহীত

পুরো নাম অ্যান্ড্রু জেমস ঈগল হলেও তিনি বেশি পরিচিত অ্যান্ড্রু ঈগল নামেই। বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ইতিহাসকে ভালোবাসা এই লেখক-সাংবাদিক গত সোমবার মারা গেছেন। সেদিন সকালে পূর্ব তিমুরের বেকাও জেলার ভাড়া বাসায় অস্ট্রেলিয়ার এই নাগরিককে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ থেকে পূর্ব তিমুর যান অ্যান্ড্রু। আগামী ১৬ ডিসেম্বর তার ৫০তম জন্মদিন।

১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে জন্ম নেওয়া অ্যান্ড্রু প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার মাটিতে পা রাখেন ১৯৯৫-৯৬ সালের শীতে, যখন তিনি তার বন্ধু ল্যাকলানের সঙ্গে ভারতে তিন মাসের ভ্রমণে বের হন। সেই সময় তার বয়স ছিল ২১ বছর। বাংলাদেশ তখন তার ভ্রমণ পরিকল্পনায় ছিল না। তবে কলকাতার মানচিত্রে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থান দেখে তিনি ভাবলেন, 'এটা তো এমন একটা দেশ, যার সম্পর্কে কিছুই জানি না। জানতে দোষ কী এই দেশ নিয়ে!'

বাংলাদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে গিয়ে বিনামূল্যে ভিসার খবর পাওয়া তার জন্য ছিল বাড়তি একটি আনন্দ। সেই উৎসাহ তাকে এবং তার ভ্রমণসঙ্গী ল্যাকলানকে ১৯৯৬ সালের শীতকালে কলকাতা থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসে। বেনাপোল সীমান্তে প্রবেশের সময় তাদের দেখা হয় ঢাকার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যিনি তাদের আন্তরিকভাবে সহায়তা করেন। এটি ছিল অ্যান্ড্রুর প্রথম অভিজ্ঞতা বাংলাদেশি আতিথেয়তার, যা পরে তার জীবনে বারবার নানাভাবে ফিরে ফিরে এসেছে।

বাংলাদেশে পা রাখার পর তিনি অনুভব করেন এখানকার উষ্ণ বাতাস এবং মানুষের অসাধারণ ভালোবাসার শক্তি। তিনি তখনই বুঝতে পারেন, এটি তার জন্য শুধু একটি দেশ নয়, বরং একটি নতুন বাড়ি, নতুন ঠিকানা। পাঁচ দিনের জন্য আসা সেই ভ্রমণ পরিণত হয়েছিল জীবনের অন্যতম এক অঙ্গনে।

১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল—এই ১১ বছরে অসংখ্যবার বাংলাদেশে আসেন অ্যান্ড্রু।

২০০৭ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস শুরু করেন তিনি। শুরুতে ছিলেন রাজধানীর ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন উত্তরায়।

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রায় দুই বছর পর তিনি দ্য ডেইলি স্টারে সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখি শুরু করেন এবং দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা ভ্রমণ করেন। তার লেখনীতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের কথা। বাঙালির আতিথেয়তা মুগ্ধ করে তাকে। ঘুরতে ঘুরতে চলে যান নোয়াখালীর হাতিয়া। এই উপজেলাকে তিনি তার 'দ্বিতীয় মাতৃভূমি' হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন লেখায়।

তার ঢাকায় বাসায় যেকেউ-ই যেতে বা থাকতে পারতেন। তবে, অগ্রাধিকার ছিল হাতিয়াবাসীর। তার ভাড়া বাসার নাম ছিল 'হাতিয়ার মেজবানখানা'।

কেবল সাংবাদিকতাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না অ্যান্ড্রু। যুক্ত হয়েছিলেন শিক্ষকতাতেও। বিশ্বজুড়ে জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপন করেন। ১০০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করা অ্যান্ড্রু জীবনের প্রতিটি স্তরে মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতি তার ভালবাসা এবং বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় ৩০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন।

অ্যান্ড্রু প্রায়ই মজা করে বলতেন, 'কেন বাংলাদেশ? কারণ ভিসা ছিল ফ্রি!' কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরতম কারণ ছিল—বাংলাদেশ তার জীবনের গল্প এবং আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। অনর্গল বাংলা বলতে পারা অ্যান্ড্রু নিজেকে 'যাযাবর' হিসেবে পরিচয় দিতেন। 'এপ্রিল' নামের একটি বইয়ের কো-রাইটার ছিলেন তিনি।

অ্যান্ড্রুর বাবা রন ঈগল গতকাল বুধবার তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অগণিত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন অ্যান্ড্রু।

লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং গ্রাম কিংবা শহরের মানুষের গল্প তুলে ধরা অ্যান্ড্রু স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার লেখার মধ্যে। মহত্ত্ব, মেধা, ও উদারতার কারণে বন্ধুদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন অ্যান্ড্রু।

Comments

The Daily Star  | English

Gaza rescuers say Israeli forces kill 60, half near aid centres

Civil defence spokesman Mahmud Bassal told AFP that five people were killed while waiting for aid in the southern Gaza Strip and 26 others near a central area known as the Netzarim corridor, an Israeli-controlled strip of land that bisects the Palestinian territory

31m ago