ঢাবিতে পিটিয়ে হত্যা

ভাত খাইয়ে ক্রমাগত পেটানো হয় তোফাজ্জলকে

পিটিয়ে হত্যা করার আগে তোফাজ্জলকে রাতের খাবার খেতে দেয় হত্যাকারীরা। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ৩৫ বছর বয়সী তোফাজ্জল হোসেনকে নির্মমভাবে মারধর করার আগে হামলাকারীরা মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার পরিবারের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেছিল।

তোফাজ্জলের মামা আব্দুর রব মিয়া টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে, অভিযুক্তরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ক্রিকেট স্টাম্প ও বাঁশের লাঠি দিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলের কাঁধ, পিঠ, পা ও উরুতে প্রচণ্ডভাবে পেটায়।

গুরুতর আঘাত ও রক্তক্ষরণের কারণে তোফাজ্জলের মৃত্যু হয়। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর হওয়া এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গত ১ জানুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসাদুজ্জামান।

তিন মাস তদন্তের পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়।

মামলার ছয় আসামি হলেন—জালাল মিয়া (২৪), আহসান উল্লাহ ওরফে বিপুল শেখ (২৪), আল হোসাইন সাজ্জাদ (২১), মো. মোত্তাকিন সাকিন সাহ (২১), মো. সুমন মিয়া (২১) এবং মো. ওয়াজিবুল আলম (২১)। তারা কারাগারে আছেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বাকি ১৫ আসামি হলেন—ফিরোজ কবির (২৩), আব্দুস সামাদ (২৩), মো. সাকিব রায়হান (২১), ইয়াছিন আলী গাইন (২১), ইয়ামুজ্জামান ইয়াম (২১), ফজলে রাব্বি (২৩), শাহরিয়ার কবির শোভন (২৪)। মেহেদী হাসান ইমরান (২৪), রাতুল হাসান (২০), সুলতান মিয়া (২৩), নাসির উদ্দিন (২২), মোবাশ্বের বিল্লাহ (২৪), শিশির আহমেদ (২১), মহসিন উদ্দিন সাফি (২২) এবং মো. আব্দুল্লাহিল কাফি (২১)। তারা পলাতক।

অভিযোগপত্রে অভিযুক্তদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়নি।

এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পরিদর্শক আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা তদন্ত থেকে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য চার্জশিটে উল্লেখ করেছি।'

চার্জশিটের শুনানির জন্য আগামী ২ ফেব্রুয়ারি আদালত দিন ধার্য্য করেছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টার দিকে ফজলুল হক মুসলিম হল মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে ছয়টি মোবাইল ফোন চুরি হয়। পরে সন্ধ্যায় একটি ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে মাঠে আসেন তোফাজ্জল।

চোর সন্দেহে ছাত্ররা তাকে ঘুষি ও লাথি মারতে শুরু করে। এরপর তারা তাকে হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে যায়।

খাবার খেতে চেয়েছিল তোফাজ্জল

গেস্ট রুমে নিয়ে ইয়ামুজ্জামান ও ইমরান তোফাজ্জলকে ক্রমাগত চড় ও ঘুষি মারতে থাকে।

অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে আদালত সূত্র জানায়, এক পর্যায়ে তোফাজ্জল প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার চায়।

তখন অভিযুক্ত ওয়াজিবুল, সুমন এবং ইয়ামুজ্জামান তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে যায় এবং তাকে ভাত খেতে দেন। তোফাজ্জল যখন খাচ্ছিলেন, তখন অন্য অভিযুক্তরা তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ক্যান্টিনে জড়ো হন।

খাওয়ার পর, অভিযুক্ত ভিকটিমকে আবার গেস্ট রুমে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে রাতুল একটি ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসেন, ইয়ামুজ্জামান ও সাকিব নিয়ে আসেন বাঁশের লাঠি। এরপর তারা তোফাজ্জলকে তার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ নম্বর দিতে বলেন। তিনি তাদের তার শ্যালিকা এবং চাচার ফোন নম্বর দেন।

অভিযুক্তরা তার চাচাকে ফোন করে টাকা দাবি করে। তার চাচা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তোফাজ্জলকে নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে পুলিশ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে, তোফাজ্জল জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তাকে মারধর চলতে থাকে।

অগ্রাহ্য করা হয় হাউস টিউটরকে

ঘটনা শুনে হলের হাউস টিউটর জহির রায়হান, মাহবুব আলম, শফিউল আলম এবং আলমগীর হোসেন গেস্ট রুমে আসেন এবং আসামিদের থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদেরকে অগ্রাহ্য করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে।

মারধরে তোফাজ্জল অচেতন হয়ে পড়লে অভিযুক্তরা তাকে আবার গেস্ট রুমে নিয়ে আসে। সেখানে তারা পালাক্রমে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে তার পা, উরু, কোমর ও পিঠে বেধরক পেটায়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তারা ভিকটিমের একটা হাত জানালার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে, তার ডান হাত পায়ের তলায় চেপে ধরে এবং ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে সারা শরীরে পেটায়।

তারা কাঁচি দিয়ে তার চুলও কেটে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম এলে, হাউস টিউটররা তোফাজ্জলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু অভিযুক্তরা তাকে প্রক্টোরিয়াল টিমের গাড়িতে তুলতে দেরি করে বলে পুলিশ তদন্তে উঠে এসেছে।

অচেতন তোফাজ্জলকে আসামি মোস্তাকিন, সাজ্জাদ, ওয়াজিবুল এবং সুমন প্রক্টোরিয়াল টিমের গাড়িতে করে হাউস টিউটরদের সাথে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ ভিকটিমের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার পরামর্শ দেয়।

পরে তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অভিযুক্তদের বাদ দেওয়া এবং অতিরিক্ত মামলা

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ছয় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জড়িত থাকার উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ চার্জশিট থেকে রকি, স্যাকলাইন, রোবটিক সোহাগ, পারভেজ, আশরাফ মুন্সি, আবু রায়হান এবং রিয়াদের নাম বাদ দিয়েছে।

পুলিশ চার্জশিটে জানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের মতো কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

চার্জশিটে প্রক্টোরিয়াল টিম বা হলের হাউস টিউটরদের সম্পর্কেও কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

জানতে চাইলে, পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, সেই সময় ক্যাম্পাসে একাধিক ঘটনা ঘটে, যার ফলে প্রক্টোরিয়াল টিমের ঘটনাস্থলে সাড়া দিতে দেরি হয়।

এ ঘটনায় গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার ফজলুল হক মুসলিম হলের সাবেক প্রভোস্ট অধ্যাপক শাহ মো. মাসুম এবং ১৪ জন শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করে আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

তবে আদালত ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫ (ঘ) ধারায় কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়ায় এ মামলার তদন্ত এখনও শুরু হয়নি।

এতে বলা হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট এই ধরনের তদন্ত বা বিচারের কার্যক্রম স্থগিত রাখবেন এবং একই অপরাধের তদন্ত পরিচালনাকারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তলব করবেন।

Comments

The Daily Star  | English
shutdown at Jagannath University

Students, teachers call for JnU 'shutdown'

JnU students have continued their blockade at the capital's Kakrail intersection for the second consecutive day

3h ago