নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি ‘মিসলিডিং’: প্রেস উইং

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত 'নতুন বাংলাদেশ গঠনের সুযোগ নিচ্ছে ইসলামি কট্টরপন্থীরা' শীর্ষক প্রতিবেদনটি 'মিসিলিডিং' বলে মন্তব্য করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

আজ মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে 'বাংলাদেশ ধর্মীয় চরমপন্থার কবলে পড়তে যাচ্ছে' বলে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেননি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলছে, প্রতিবেদনটি বিভ্রান্তিকর ও একপাক্ষিক। এতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে সরলভাবে দেখা হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বাছাইকৃত কিছু ঘটনা তুলে ধরে ভ্রান্ত ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে প্রেস উইং।

প্রেস উইং ফ্যাক্ট ফেসবুক পেজে এক পোস্টে পয়েন্ট আকারে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা বক্তব্যগুলোকে খণ্ডন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জের বাস্তবতার উল্লেখ করে ওই পোস্টে বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি, বাংলাদেশের বৈশ্বিক অগ্রগতির কথা উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের সমসাময়িক বিষয়গুলোকে একপাক্ষিক অতি সরলীকরণ করে বিচার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রেস উইং থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ নারীদের অবস্থার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এটি এমন একটি সরকার যা নারীর অধিকার ও সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যা নিবন্ধে তুলে ধরা আবছা চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো 'যুব উৎসব ২০২৫', যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে ৩ হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল।

বিভিন্ন অঞ্চল, প্রান্তিক সম্প্রদায় এবং আদিবাসী যুব সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে নারী ও মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত ও গতিশীল সম্পৃক্ততার প্রতিফলন। 

একটি ফুটবল খেলা বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি অন্যান্য ২ হাজার ৯৯৯টি ইভেন্টের সাফল্যকে মুছে ফেলে না, যা অসংখ্য অংশগ্রহণকারী ও সম্প্রদায় উদযাপন করেছিল।

একটি অনুষ্ঠানে একটি মাত্র বাধার বিষয়ে আলোকপাত করার মাধ্যমে দেশের যুব সমাজের, বিশেষত নারীদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ ও দৃঢ় অঙ্গীকারের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস 'চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোরভাবে প্রতিরোধ করেননি' এই দাবি কেবল মিথ্যাই নয়, বরং এটি নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি তার আজীবন প্রতিশ্রুতিকেও উপেক্ষা করে।

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস নারীর অধিকারের পক্ষে তার অবস্থানে অটল রয়েছেন। দুই কন্যার পিতা, ইউনূস তার সমগ্র কর্মজীবন এবং গ্রামীণ ব্যাংককে নারীর শক্তিতে তার গভীর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন, যা শেষ পর্যন্ত তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।

নারীর অধিকার এগিয়ে নেওয়া এবং তাদের স্বাধীনতা রক্ষায় তার নিষ্ঠা ও কাজ তার খ্যাতির ভিত্তি।

ধর্মীয় সহিংসতা সম্পর্কে ভুল ধারণা সংশোধন

বাংলাদেশের মতো দেশে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় সহিংসতার মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত অনেক সংঘর্ষকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও বাস্তবে, সেগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রকৃতির ছিল।

রাজনৈতিক বিভিন্ন দল অনেক সময় সমর্থন লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, যা বিষয়টিকে জটিল করে তোলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে ধর্মীয় নিপীড়নের মিশ্রনের ঝুঁকি তৈরি করে। পুরো পরিস্থিতিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসেবে উপস্থাপন করা বিভ্রান্তিকর, কারণ এটি প্রকৃত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কারণগুলোকে উপেক্ষা করে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তার প্রতিশ্রুতি সুস্পষ্ট করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চলমান কাজ এবং সন্ত্রাসবাদ দমন প্রচেষ্টা এই প্রতিশ্রুতিকে আরও জোরদার করে।

সামাজিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে চরমপন্থা মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে ম্লান হওয়া উচিত নয়।

বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভূমিকা

বাংলাদেশ নীরবে এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, একটি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় যা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রচুর সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়।

সব প্রতিকূলতার মধ্যেও, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়েছে যা উল্লেখযোগ্য স্থিতিস্থাপকতার প্রতিফলন।

গত সাত মাসে, রপ্তানি প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পরেও ব্যাংকিং খাত গতিশীল রয়েছে এবং স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রায় ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।

সামনের দিকে তাকালে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস গত আট মাস ধরে যেসব অবিশ্বাস্য কাজ সম্পন্ন করেছেন তার স্বীকৃতি কোথায়? বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য তিনি সারা বিশ্বজুড়ে সফর করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।

গত সপ্তাহে চীন সফরের সময় চীন সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে দুই দশমিক এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ঢাকা আগামী সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের সম্মেলন আয়োজন করবে, যেখানে ৫০টি দেশের দুই হাজার ৩০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী অংশগ্রহণ করবেন, যার মধ্যে মেটা, উবার ও স্যামসাংয়ের মতো বৈশ্বিক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারাও থাকবেন।

বিশ্ব ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটি হচ্ছে আশা, শক্তি ও অভূতপূর্ব সুযোগের গল্প—যা সম্মান ও যথাযথ বিবেচনার দাবি রাখে।

অতি সরলীকরণ এড়িয়ে চলা এবং একটি জাতিকে অপবাদ দেওয়া

নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যেমন একজন নারীর ওপর নির্যাতনকারী একজন ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা একটি দেশের চরমপন্থায় পতিত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে।

এটি কেবল বিভ্রান্তিকরই নয় বরং ক্ষতিকারক। ১৮ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দ্বারা সমগ্র দেশকে সংজ্ঞায়িত করা অযৌক্তিক।

বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল সমাজ যেখানে সহনশীলতা, সংস্কৃতি এবং প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ একা নয়; এটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা যা অনেক দেশ বিভিন্ন রূপে মোকাবিলা করে।

তবে, আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য ক্রমাগত কাজ করে আসছে।

মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য যেকোনো সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
 
বিভিন্ন সমাবেশে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণা ছড়ানোর জন্য সব সময়ই কট্টরপন্থীরা সক্রিয় থাকলেও তাদের ক্ষোভে ঘৃতাহুতি না দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

এছাড়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে চরমপন্থার উত্থান অনিবার্য এমন চিন্তা অত্যন্ত পূর্বধারণাপ্রসূত।

দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ এমন শক্তিশালী যা চরমপন্থী মতাদর্শের উত্থানকে প্রতিহত করে চলেছে।

চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি গতিধারা কেবল চরমপন্থীদের কর্মকাণ্ড দ্বারা নির্ধারিত হবে না।

বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে এর যুব সমাজ ও মহিলারা একটি ন্যায়সঙ্গত, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পরিশেষে, বাংলাদেশের সহনশীলতার ইতিহাস, গণতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের ওপর তার মনোযোগ এই সত্যের প্রমাণ যে, দেশটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও এগিয়ে যাবে।

কয়েকটি নেতিবাচক উদাহরণের উপর মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে, আমাদের আজকের বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করে এমন অগ্রগতি, সহনশীলতা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের ব্যাপকতর চিত্রটির স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

3h ago