এয়ার কার্গো সক্ষমতা বাড়াতে তৎপর বাংলাদেশ

এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশি পণ্য তৃতীয় দেশে ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য ভারতীয় বন্দর ব্যবহারের সুবিধা বাতিল করা হয়। হঠাৎ করে ভারত এমন সিদ্ধান্ত জানানোর ফলে খানিকটা বিপাকেই পড়েন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। এরপরই তড়িঘড়ি শুরু হয়েছে দেশের কার্গো বিমান সক্ষমতা বাড়ানোর।

কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ৮ এপ্রিল এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ভারত। এর ফলে বাংলাদেশের পণ্য সড়কপথে কলকাতা ও দিল্লি নিয়ে সেখানকার বিমানবন্দর হয়ে বৈশ্বিক বাজারে পাঠানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডর বন্ধ হয়ে যায়।

এই বাধার মুখে পড়ে রপ্তানি চ্যানেলে পরিবর্তন এনে এবং ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের সক্ষমতা দ্রুত বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ।

তারই অংশ হিসেবে আজ রোববার সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশেষায়িত কার্গো কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পর এটি হতে যাচ্ছে দেশের দ্বিতীয় মালবাহী ফ্লাইট পরিচালনাকারী বিমানবন্দর।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কার্গো বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাকিল মেরাজ জানান, গালিস্টেয়ার এভিয়েশনের একটি চার্টার্ড এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০ ফ্রেইটার আজ সন্ধ্যা ৭টার দিকে সিলেট থেকে স্পেনের উদ্দেশে যাত্রা করবে। এই ফ্লাইটে প্রায় ৬০ টন তৈরি পোশাক পরিবহন করা হবে। চালানটি যাবে স্পেনের বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্সের কাছে।

এই উদ্বোধনী ফ্লাইটে কার্গো ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন মেক্সিকোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম মুশফিকুল ফজল আনসারী এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন সচিব নাসরীন জাহান।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিএএবি) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মনজুর কবির ভূঁইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিলেট থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের মানদণ্ড পূরণে এখানে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, এক্স-রে স্ক্যানার এবং অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে।'

বাংলাদেশের কার্গো পরিচালন সক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণের বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে সিলেট থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে এভিয়েশন কর্মকর্তারা ২০২২ সাল থেকে নিষ্ক্রিয় থাকা চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও বিশেষায়িত কার্গো কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ২১ এপ্রিল এক জরুরি সভায় পরিচালনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করার বিষয়ে আলোচনা হয়। বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন শেখ আবদুল্লাহ আলমগীর জানান, কার্গো সেবা পুনরায় চালুর প্রস্তুতি চলছে এবং প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে অন্তত দুটি বড় কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, 'ভারতের এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আমাদের আরও স্বনির্ভর হওয়ার সময় এখনই।'

বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল জানান, আমদানি কার্গোর জন্য ২৫০ টন এবং রপ্তানির জন্য ২০ টন মালামাল ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কার্গো স্টেশন গত দুই বছর ধরে ব্যবহার হয়নি। কারণ, এখানে আমদানি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে।

শিল্প সংশ্লিষ্টরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও জোর দিয়ে বলেছেন, কার্গো ফ্লাইট পরিচালনায় দীর্ঘমেয়াদে সফলতা পেতে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ব্যয় করতে হবে।

বাংলাদেশ ফ্রেট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, 'এই সেবা খণ্ডকালীন হওয়া যাবে না। রপ্তানি চালানের জন্য স্ক্রিনিং ও স্ক্যানিং যন্ত্রপাতিসহ সব সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রপ্তানিকারকরা নিয়মিত এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে উৎসাহিত হন।'

তিনি উল্লেখ করেন, সিলেটের কার্গো অবকাঠামো এতদিন বেশিরভাগই অব্যবহৃত ছিল।

তিনি জানান, এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে খরচের ওপরও। সিলেট থেকে ইউরোপে নিয়মিত ফ্লাইটের ক্ষেত্রে যদি কেজিপ্রতি ২.৬ থেকে ২.৭ ডলারের মধ্যে ভাড়া রাখা যায়, তাহলে রপ্তানিকারকরা আগ্রহী হবেন। চার্টার্ড ফ্লাইটের ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি প্রায় ৩.৫ ডলার ভাড়া হলেও সেটা প্রতিযোগিতামূলক হবে।

সতর্কবার্তা দিয়ে কবির আহমেদ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো সেবার ক্ষেত্রে সরকার যেন নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সব রপ্তানিকারকের জন্য উন্মুক্ত রাখে।

ব্যয়ের পার্থক্য

ফ্রেট ফরোয়ার্ডিং শিল্পের হিসাব অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞার আগে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট তৈরি পোশাকের মধ্যে প্রায় ৬০০ টন বা ১৮ শতাংশ ভারতীয় বিমানবন্দরগুলোর মাধ্যমে রপ্তানি করা হতো।

করোনা মহামারির সময় আলোচনায় আসা ভারতীয় এই রুট দিয়ে ঢাকা থেকে সরাসরি শিপমেন্টের চেয়ে দ্রুত ও কম খরচে পণ্য পরিবহন করা যেতো।

এখানে ব্যয়ের পার্থক্য বেশ উল্লেখযোগ্য। ফ্রেট ফরোয়ার্ডারদের মতে, স্থলপথের পরিবহন ব্যয় যোগ করার পরও ভারত হয়ে ইউরোপে পোশাক পাঠাতে প্রতি কেজিতে খরচ হতো প্রায় ২.৬ ডলার। অথচ, ঢাকা থেকে অফ-পিক সময়ে খরচ ২.৯ থেকে ৩.২ ডলার এবং পিক সিজনে তা বেড়ে ৪.৫ ডলার পর্যন্ত হতো।

দীর্ঘদিন ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রয়েছে ধারণক্ষমতা সংকট এবং পরিচালনগত অদক্ষতা। দিনে ৩০০ টন কার্গো সামাল দেওয়ার জন্য তৈরি করা কার্গো ভিলেজ অফ-পিক সময়ে ৮০০ টন এবং পিক সময়ে এক হাজার ২০০ টন পর্যন্ত পণ্য ব্যবস্থাপনা করে।

মালামাল খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা এবং উচ্চ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ফিয়ের কারণে রপ্তানিকারকরাও হতাশ হন। যেখানে ঢাকায় প্রতি কেজিতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ফি ২৯ সেন্ট, সেটা দিল্লিতে মাত্র ৫ সেন্ট।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৩৬টি দেশে ৩৪ হাজার ৯০০ টনের বেশি পোশাক পাঠিয়েছেন, যার মূল্য ৪৬২.৩৪ মিলিয়ন ডলার।

ওই ১৫ মাসে ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ যেসব পোশাক রপ্তানি করেছে তার মধ্যে ছিল ব্লাউজ, ট্রাউজার, টি-শার্ট ও শিশুদের পোশাক। প্রধান বাজারের মধ্যে যেমন ছিল যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া; এর পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চিলির মতো নন-ইউরোপীয় গন্তব্যেও গেছে এসব পণ্য।

সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি) এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস যৌথভাবে বেসামরিক বিমান চলাচল সংক্রান্ত ট্যারিফ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ পুনর্নির্ধারণ করছে প্রতিযোগিতা বাড়াতে।

এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মনজুর কবির ভূঁইয়া বলেন, 'আমরা শিগগির হ্যান্ডলিং চার্জ কমানোর ঘোষণা দেবো।'

তিনি জানান, সংস্কার কার্যক্রম সমন্বয় করার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এ ছাড়া, দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যাশা এখন বহু প্রতীক্ষিত শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনালের ওপর। আগামী বছরের শুরুর দিকে এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। চালু হলে নতুন ৩৬ হাজার বর্গমিটার আয়তনের কার্গো জোনের সহায়তায় নিয়ে ঢাকার রপ্তানি কার্গো সক্ষমতা বার্ষিক দুই লাখ টন থেকে বেড়ে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার টনে উন্নীত হবে।

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আরও বিস্তৃত পরিসরের রপ্তানিকারকদের সেবা দিতে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো চালান সুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

তবে তিনি স্বীকার করেন, শাহজালালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ না কমালে অন্য বিমানবন্দরগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

তিনি বলেন, 'সরকার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ কমাবে এবং জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনবে। এতে করে মোট পরিবহন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago