৪ জেলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান মামলায় আসামি ১৩৭ সাংবাদিক

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে দায়ের হওয়া ৩২টি ফৌজদারি মামলায় অন্তত ১৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।
মামলার নথি ও পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, অবৈধ সমাবেশ, দাঙ্গা, অপহরণ, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি, হামলা এবং কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত বছরের ২১ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২০ এপ্রিলের মধ্যে এই ৩২টি মামলা করা হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টার অধিকাংশ মামলার নথি সংগ্রহ করেছে।
অনেক মামলায় পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাংবাদিকদেরও আসামি করা হয়েছে।
এমনকি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও মামলা করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও একাধিক মানবাধিকারকর্মী।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, টিভি টকশোতে বক্তব্য ও প্রশ্নের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎসাহিত করেছেন এমন সাংবাদিকদের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'অনেক সাংবাদিক শেখ হাসিনার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় তারা তাকে সহযোগিতা করেছেন।'
তাহলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেন হত্যা মামলা করা হচ্ছে? জানতে চাইলে ফারুকী বলেন, 'তারা সরাসরি জড়িত না হলেও বক্তব্যের মাধ্যমে সহায়তা করেছেন।'
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'জুলাই আন্দোলনে হত্যার অভিযোগে সারা দেশে বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।'
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুর্বৃত্তরা ব্যক্তিগত স্বার্থে ফৌজদারি প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে। যেসব এলাকায় আন্দোলন হয়নি বা কেউ মারা যায়নি, সেখানেও অন্যান্যদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে।'
হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রূপা ও শাকিল আহমেদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তারা অন্য কোনো অপরাধ করে থাকতে পারেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা একেবারেই অস্পষ্ট।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে সাংবাদিকরা নিয়মিত হুমকি ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হন। ৫ আগস্টের পর তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা একটি নতুন প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি স্পষ্টতই সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত পেশাগত স্বাধীনতার পরিপন্থী।'
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, 'মামলাগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে আন্তরিকতার সঙ্গে। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়া হবে।'
তিনি বলেন, 'নির্দোষ কাউকে হয়রানি না করার জন্য তদন্তকারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।'
সবচেয়ে বেশি মামলা ঢাকায়
ঢাকায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, অবৈধ সমাবেশ, দাঙ্গা ও অন্যান্য অভিযোগে ৭৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১৯টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে দুটি মামলা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
রূপা, শাকিল, মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্ত, শেখ মোহাম্মদ জামাল হোসেন ও আরিফ হাসানসহ কয়েকজন সাংবাদিককে ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।
তাদের মধ্যে জামিন পেয়েছেন শেখ মোহাম্মদ জামাল হোসেন।
সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর এলাকায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় বিএনপি কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণের মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ৪০৭ জনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় ২৪ জন সাংবাদিককেও আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে ৩৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে।
বগুড়ায় ২২ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ মোট আটটি মামলা হয়েছে। এই সাংবাদিকদের মধ্যে অন্তত চারজন ঢাকায় কর্মরত।
রাজশাহীতে ভাঙচুর, চাঁদাবাজি ও হামলার অভিযোগে ১৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা হয়।
একটি সংবাদ সম্মেলনের উদ্ধৃতি দিয়ে অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্ত সাংবাদিকরা 'বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে উসকানিমূলক মন্তব্য করে শেখ হাসিনাকে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে নির্মূল করতে প্ররোচিত করেছিলেন।'
এতে আরও দাবি করা হয়, ওই সাংবাদিকরা তৎকালীন সরকারের 'চাটুকার' হিসেবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি দিতে 'মিথ্যা খবর প্রকাশ করেছিলেন'।
এ মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনার সাবেক প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান, সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টিভির মোজাম্মেল বাবু, নবনীতা চৌধুরী, এবিনিউজ২৪ডটকম-এর সুভাষ সিং রায়, সময় টিভির আহমেদ জোবায়ের, এখন টিভির তুষার আবদুল্লাহ, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম ও সমকালের সাবেক সম্পাদক আবেদ খান।
সোমবার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ২৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে ডিইউজে সভাপতি সাজ্জাদ আলম খান তপু ও সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অস্পষ্ট ও ব্যাপক অভিযোগ আনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি।
তারা আরও বলেন, যদি পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা হতে থাকে, তাহলে এই পেশায় বিদ্যমান ভয়ের সংস্কৃতি কখনোই দূর হবে না।
Comments