মামলার এই পাহাড় নামবে কবে

দেশের আদালতগুলোতে মামলার জট বেড়েই চলেছে। বিচারাধীন মামলার পাহাড় ডিঙিয়ে আদালতের রায় পাওয়া বহু মানুষের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের এ বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট এবং অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩। ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৪। অর্থাৎ, গত ১৬ বছরে মামলাজট আড়াই গুণেরও বেশি বেড়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৯৩টি মামলা বিচারাধীন মামলার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই নতুন মামলা হয়েছে ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩টি, আর নিষ্পত্তি হয়েছে ১২ লাখ ১ হাজার ২৪০টি।
বর্তমানে হাইকোর্টের প্রত্যেক বিচারপতিকে গড়ে ৬ হাজার ৫৫২টি মামলা পরিচালনা করতে হচ্ছে। আপিল বিভাগের প্রত্যেক বিচারপতির ঘাড়ে রয়েছে ৪ হাজার ৪৪৬টি মামলা এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১ হাজার ৯৭৭।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে সম্প্রতি ১৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিচারহীনতার ভোগান্তি
মামলাজটের কারণে বিচারপ্রার্থীরা কীভাবে বছরের পর বছর ধরে ভুগছেন, তার দুটি উদাহরণ ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি এবং ঢাকার ইশতিয়াক হোসেন জনি হত্যাকাণ্ড।
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে চারজন মিলে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর কিছুদিন আগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করায় এই ঘটনা ঘটানো হয়। চার দিন পর হাসপাতালে মারা যান নুসরাত। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই মামলায় ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ফেনীর একটি আদালত অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন।
কিন্তু এরপর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের নথি) এবং আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন মামলাটি নিষ্পত্তি হচ্ছে না, তা আমরা জানি না। আসামিদের আত্মীয়স্বজনেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।'
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে ২৮ বছর বয়সী ইশতিয়াক হোসেন জনিকে হেফাজতে পিটিয়ে হত্যার মামলা। ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে জনি ও তার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। পরে থানায় নির্যাতনে জনির মৃত্যু হয়।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে নারীদের উত্ত্যক্ত করার কারণে জনি পুলিশ সোর্স সুমনকে চড় মারেন। এরপরই সুমন ও রাসেল পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ দুই ভাইকে থানায় নিয়ে নির্যাতন করে।
এর পরের দিন জনিকে একটি স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি মারা যান।
২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালত এসআই জাহিদসহ তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুই পুলিশ সোর্সকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন জানান, মামলাটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিচারাধীন থাকলেও এখনো শুনানিই শুরু হয়নি। তিনি বলেন, 'আসামিদের মধ্যে জাহিদ ও রাশিদুল কারাগারে থাকলেও মিন্টু পলাতক। অন্য দুই আসামি সুমন ও রাসেলও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ও আমার পরিবারকে নিয়ে আতঙ্কে আছি।'
মামলাজট কমাতে অধস্তন আদালতগুলোকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় এনে 'ই-জুডিশিয়ারি' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর আওতায় আদালত, থানা, কারাগার এবং মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত হবেন।
সম্প্রতি 'সুপ্রিম কোর্ট জাজেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট অর্ডিন্যান্স, ২০২৪' জারি করা হয়েছে। এর অধীনে গত ২৪ মার্চ হাইকোর্টের দুজন বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়ায় বিচারপতির সংখ্যা সাতে উন্নীত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই হাইকোর্টে আরও বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা ৯৫, যা ২০১২ সালে ১০০ জন ছিল।
এ ছাড়া, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পাঁচজন বিচারপতির অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভের পর গত বছরের ২০ অক্টোবর থেকে তাদের বিচারিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব বলেন, 'বিচারকদের আরও প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। নিম্ন আদালতে প্রযুক্তিগত সহায়তা খুবই কম।' তিনি আরও বলেন, যারা মিথ্যা মামলা দায়ের করে বা ঘন ঘন সময় আবেদন করে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
তিনি যোগ করেন, 'আমাদের দেওয়ানি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি উভয়ই সংস্কার করা দরকার। এই ঔপনিবেশিক আমলের আইনগুলো সালিস বা মধ্যস্থতার মতো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট সহায়ক নয়।'
Comments